২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রথম সমাবর্তনে ‘সমাবর্তন বক্তা’ তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিনি।
২০০৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অবসর নেন। পদার্থ বিজ্ঞানে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে তাকে ‘প্রফেসর এমিরিটাস’ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৪১ সালের ১৭ অক্টোবর পাবনা শহরের রাধানগরে জন্ম নেওয়া প্রফেসর ড. অরুণ বসাক ১৯৫৭ সালে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে ঢাকা বোর্ডে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর ১৯৫৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন।
রাজশাহী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে রাবির পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
পিএইচডি করেছেন ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটিতে। সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষকতা ও ব্যক্তিজীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাবি করেসপন্ডেন্ট মঈন উদ্দিন।
বাংলানিউজ: স্যার, প্রথমেই শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে আপনি সমাবর্তন বক্তা। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি যদি বলেন?
ড. অরুণ কুমার বসাক: সংবাদটি জানার পর আমার কাছে ‘সারপ্রাইজ’ মনে হলো। কারণ আমি এতটা আশা করিনি। আমি কোথাও সেইরকমভাবে পরিচিত না। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো তাতে আমি কিছুটা স্তম্ভিত হয়েছি। তাছাড়া একটু খুশি তো লাগেই। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তা বিশাল ব্যাপার। কিন্তু একটু ভয়ও কাজ করছে, আমি কী ঠিক মতো কথা বলতে পারবে কি-না। একটু অসুস্থ। তবে এ নিয়ে একটু উত্তেজনাও কাজ করছে।
বাংলানিউজ: আপনার অনেক গবেষণা রয়েছে। নিউক্লিয়ার বিষয়ক তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করেছেন।
ড. অরুণ কুমার বসাক: তা ঠিক, আমি অনেক গবেষণা করেছি। তবে আমার কোনো গবেষণাকে আমি ব্যর্থ হতে দিইনি। গবেষণা করতে গিয়ে নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। তবুও পিছু হটে যাইনি। ভালো কিছু করতে গেলে মানুষ বাধার সম্মুখীন হবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া মানুষের জীবনে বাধা না থাকলে বড়ও হয় না। আমার পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সব বাধাকে জয় করেছি। বলা যায়, পরিশ্রম করলে কোনো কিছু বিফলে যায় না।
বাংলানিউজ: ২০০৮ সালে আপনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। বয়স হয়েছে তবুও সেই পেশাতে আছেন, এটা কেন?
ড. অরুণ কুমার বসাক: আমাকে যখন প্রফেসর এমিরিটাস করা হয়, তখন মনে হয়েছিলো আমার তো ডিপার্টমেন্টের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। যদিও আমাকে ফরমালি কোনো ক্লাস দেওয়া হয় না। কিন্তু আমার যে কয়টা সন্তান (শিক্ষার্থী) রয়েছে তাদের যদি আমি কিছু জ্ঞান দান করে যেতে পারি ও কিছু গবেষণা যদি শিখিয়ে যেতে পারি তাহলে সেটি হবে আমার মনের সন্তুষ্টি। এ কারণেই আমি এখনও শিক্ষকতা করছি।
বাংলানিউজ: একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী বিষয়ে যদি বলেন…।
ড. অরুণ কুমার বসাক: আমি মনে করি একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে তাকে নীতিবান হতে হবে, কথায় কাজে ঠিক থাকতে হবে। কোনো লোভ থাকবে না, ধর্ম নিরপেক্ষ, দক্ষ ও বিবেকবান হতে হবে। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমানে একজন নীতিবান শিক্ষক পাওয়া দুষ্কর।
বাংলানিউজ: পদার্থ বিজ্ঞানে বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র প্রফেসর এমিরিটাস আপনি। এ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. অরুণ কুমার বসাক: আমি এটা খুব বড় কিছু মনে করি না। সেটার কারণ হলো এই প্রফেসর এমিরিটাস হওয়াতে অনেক পলিটিক্স হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষক ছিলেন যারা এটা হতে পারতেন। ঢাবিতে শুধু ফিজিক্স ছাড়া সব ডিপার্টমেন্টেই কম বেশি প্রফেসর এমিরিটাস আছে। তার কারণ হলো পলিটিক্স। তবে আমি বলতে চাই, আমি প্রফেসর এমিরিটাস হয়েছি বলে এই না যে আমি বাংলাদেশের সেরা পদার্থ বিজ্ঞানী।
বাংলানিউজ: তরুণ বয়সে শিক্ষক হিসেবে বিভাগে যোগ দেন। এখন বয়স হয়েছে তবুও মনের দিক দিয়ে আপনি চির তরুণ। এটা কীভাবে সম্ভব?
ড. অরুণ কুমার বসাক: আমি একটা জিনিস বুঝেছি যে, বৃদ্ধত্ব ও অকর্মণ্যতা এ দুটি জিনিস নিজের ওপরেই নির্ভর করে। যে বেশি আরাম-আয়েশ করবে তাকে বৃদ্ধত্ব পেয়ে বসবে। যে যত সক্রিয় থাকবে তার শরীর ততই ভালো থাকবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিশ্রমী হয়ে না ওঠার জন্য দায়ী আমরাই। তবে তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, শেখার ও পড়ার দায়িত্ব তোমার। তবে মুখস্থ নয়, সেটা বুঝে বুঝে পড়তে হবে।
বাংলানিউজ: আপনি যা অর্জন করেছেন, এর পেছনে কার অবদান রয়েছে?
ড. অরুণ কুমার বসাক: হ্যাঁ, অবশ্যই আমার শিক্ষকেরা। এর মধ্যে আমার কলেজের মাখনলাল চক্রবর্তী স্যার। আরেকজন হলেন আমার স্কুলের হেডমাস্টার রাজাবিনোদ বসাক। তিনি আমার মায়ের আপন মামা ছিলেন। তবে আমার সব শিক্ষকেরই আমার উন্নতির পেছনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাদের আমি এখনও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
বাংলানিউজ: ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মানুষকে পুরস্কৃত করা হয়। আর সেই পুরস্কার থেকে ভালো কাজের প্রতি আরও আগ্রহ বাড়ে। আপনার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে কী?
ড. অরুণ কুমার বসাক: হ্যাঁ, কিছুটা অনুভব করেছি। এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন- হঠাৎ করেই তুমি সফলতা পেলে এবং তাতেই তুমি থেমে যেও না, উদ্যমকে হারিয়ে ফেলো না। কারণ তুমি যদি পরে আর সফলতা না দেখাতে পারো তাহলে মানুষ ভাববে, ওটা কাকতালীয়ভাবে বা হঠাৎ করে পেয়ে গেছে। আমি এই উক্তিটির সাথে মিলিয়ে দেখতাম। পুরস্কার পাওয়ার পর মনে হলো আমাকে যে এই সম্মানটি দিলো তা কি আমি রক্ষা করতে পারবো? তখন আরও ভালোভাবে কাজ করতাম। পুরস্কার পাওয়ার সম্মান রক্ষা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
বাংলানিউজ: জীবদ্দশায় আর কী দেখে যেতে চান?
ড. অরুণ কুমার বসাক: আমার জীবনের শেষ ইচ্ছেটা হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বে একটা অবস্থানে দেখা। আমার মনে একটা ব্যথা হলো যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেমনটা হওয়া উচিৎ ছিলো সেভাবে হয়ে ওঠেনি। রাবির পর গড়ে ওঠা ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের স্ট্যান্ডার্ড অনেক উর্ধ্বে, যা আমরা পারিনি। আর তাদের মতো মর্যাদাও নেই। এর কারণ হলো আমরা মর্যাদা আদায় করার ক্ষমতা রাখি না। আমার আরেকটা ইচ্ছে, যদি সরকার আমাকে বলতো যে তুমি কি চাও? তখন আমি বলতাম আমার তিনজন স্যারকে যদি পুরস্কৃত করতেন। তারা হলেন- আমার কলেজের শিক্ষক মাখনলাল চক্রবর্তী, স্কুলের শিক্ষক রাধাবিনদ বসাক ও রাজশাহী সরকারি কলেজের শিক্ষক লুৎফর রহমান।
বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. অরুণ কুমার বসাক: বাংলানিউজকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯
এমএ/