ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

স্কুলে না এসেও বেতন নেন দপ্তরি, প্রক্সি দেন ‘জজ’

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০২২
স্কুলে না এসেও বেতন নেন দপ্তরি, প্রক্সি দেন ‘জজ’

বাগেরহাট: দায়িত্ব পালন না করেও বেতন নেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার ৯৭ নম্বর একরামখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম প্রহরী ইমরান খান।  

এমনকি সময়মত হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর করেন না তিনি।

তার স্থানে মাসিক পাঁচ হাজার টাকায় মো. রায়হান জজ নামের এক যুবক দায়িত্ব পালন করেন। মো. ইমরান খানের এসব অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকরাও কথা বলেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে দপ্তরি ইমরান খানের বিরুদ্ধে।

এছাড়া এলাকায় প্রভাব বিস্তার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও প্রতিপক্ষকে মারধরসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মোরেলগঞ্জ থানায় বিভিন্ন অপরাধে অন্তত ৬টি মামলা রয়েছে ইমরান খানের নামে। একটি মামলায় ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন ইমরান খান।
বৃহস্পতিবার (০৩ নভেম্বর) বেলা ১১টায় ৯৭ নম্বর একরামখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার ও সহকারী শিক্ষক নিয়াজ পারভেজ দায়িত্ব পালন করছেন।  

দপ্তরি কোথায় জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার বলেন, একবার বাজারে গেছে, আবার বলেন, মোরেলগঞ্জ ব্যাংকে গেছে।  

দপ্তরির হাজিরা খাতা দেখতে চাইলে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি লাগবে।  

পরে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সজল মহোলী হাজিরা খাতা দেখানোর নির্দেষ দিলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার হাজিরা খাতা দেখান। হাজিরা খাতায় দেখা যায়, দপ্তরি ইমরান খান সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করেছেন। পুরো অক্টোবর মাস এবং নভেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত হাজিরা খাতায় কোনো স্বাক্ষর করেননি তিনি। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে পুরো ৩০ দিন এবং অক্টোবরে ৩১ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন মর্মে প্রতিবেদন দিয়ে ১৪ হাজার ৪৫০ টাকা বেতন দিতে সুপারিশ করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার।

এসব বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার বলেন, স্বাক্ষর দেওয়ার নিয়ম ছিল, কিন্তু সে স্বাক্ষর দেয়নি।  
স্বাক্ষর ছাড়াই পুরো বেতন দিতে সুপারিশ করার কারণ জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।  

বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের দপ্তরি তো রায়হান জজ ভাই। তিনিই আমাদের ঘণ্টা দেন, সব কাজ তিনিই করেন। ইমরান কখনওই বিদ্যালয়ে আসেন না।  

চান মিয়া শিকদার নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়ে যখন ভর্তি হইছে, তখন তো দেখছি, সব কাজ রায়হান জজ করেছে। রায়হানই তো স্কুলে দায়িত্ব পালন করে। ইমরান তো বিভিন্ন জায়গায় রাজনীতি করে বেড়ায়। স্থানীয় অনেকে জানেই না যে ইমরান খান এখানকার দপ্তরি।

বিদ্যালয়ের বিভিন্ন নথি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি মোরেলগঞ্জ উপজেলার চন্দনতলা গ্রামের ইউসুফ আলী খানের ছেলে ইমরান খান ৯৭ নম্বর একরামখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পর স্থানীয় আমিনুল ইসলাম নামে এক যুবক মাসিক আড়াই হাজার টাকায় ইমরানের বদলি (প্রক্সি) দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে রাসেল স্বর্নমদ নামে আরেক যুবক মাসিক চার হাজার টাকায় তার প্রক্সি দেন তিন বছর। বর্তমানে মাসিক পাঁচ হাজার টাকায় স্থানীয় রায়হান জজ তার দায়িত্ব পালন করছেন। আট বছরের চাকরি জীবনে কখনও নিজের দায়িত্ব পালন করেননি স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ইমরান খান।

বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ২০১৫ সালের পরে আমি দুই বছর দায়িত্বে ছিলাম। এসময়ে ইমরান কখনও দায়িত্ব পালন করেনি। সে রাজনৈতিক কাজে দৌড়াদৌড়ি করত। তাকে দায়িত্ব পালন করতে বলায় আমাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।  

বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি সোহাগ বলেন, ঝড়-বন্যাসহ বড় ধরনের বিপদ আপদেও ইমরানকে ফোন করলে সে স্কুলে আসেনি। তার লোক পাঠিয়ে দিত।
 
এ বিষয়ে জানতে বর্তমান সভাপতি জাহিদকে ফোন করলে তিনি সব কিছু শুনে পরে কথা বলব বলে ফোন কল কেটে দেন।

বদলি দায়িত্ব পালনকারী রায়হান জজকে ফোন করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

দপ্তরি ইমরান খানের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলেও তার বাবা এ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ইউসুফ আলী খান বলেন, এসব অনিয়ম আমরা বুঝি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ওপরে আদালত রয়েছে। আদালতের ওপরে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। আমরা সেখানে বুঝবো।

এ বিষয়ে বাগেরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মু. শাহ আলম বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। সঠিক তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে দপ্তরির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।