ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

কলিম শরাফীর চিরবিদায়

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১০
কলিম শরাফীর চিরবিদায়

‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে...’ নিজের গাওয়া গানের মতোই নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফী। সবাইকে কাঁদিয়ে জীবন নদীর ওপারে চলে গেছেন তিনি।

  ২ নভেম্বর মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৫০মিনিটে উত্তর বারিধারার নিজ বাসভবনে কলিম শরাফী  মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৬ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে, এক কন্যাসহ অগুনতি শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমেছে গভীর শোকের ছায়া।

কলিম শরাফীর মরদেহ সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নিয়ে আসা হয়। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষরা তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমান। রাত সাড়ে ৭টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর ঢাকার মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শিল্পী কলিম শরাফীর মুখর জীবন
 
কলিম শরাফীর জন্ম ১৯২৪ সালের ৮ মে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউড়ী মহকুমার খয়রাডিহি গ্রামে, নানাবাড়িতে। কলিম শরাফীর পুরো নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। গ্রামের লেটোর গান, ঝুমুর গান, আলকাফ, কীর্তন দেখতে দেখতেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। সবার অলক্ষ্যই সঙ্গীতের প্রতি এক অনির্বচনীয় টান যেন বাসা বাঁধে তার মনের গভীরে।

কলিম শরাফীর তার পূর্বপুরুষ মধ্যপ্রাচ্য থেকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন। বিহার শরিফের পীর হযরত শারফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরির উত্তরাধিকারী হিসেবে তার পীরের আসনে বসার কথা ছিল। কিন্তু তার বাবা শাহ সৈয়দ সামী আহমেদ শরাফী নিজে পীরের আসনে বসেননি, আর তার সন্তান কলিম শরাফীও বাবাকে অনুসরণ করেছেন। আরো মজার ব্যাপার হলো, তাদের ছিল পারিবারিকভাবে সিনেমা হলের ব্যবসা।

ছাত্রজীবনে কলিম শরাফী মহাত্মা গান্ধীর ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এজন্য একাধিকবার তাকে কারাবরণও করতে হয়েছে। ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’-এ চারদিকে ুধাতাড়িত মানুষের জন্য হৃদয়ভেদী গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন কলিম শরাফী। দল বেঁধে গান গেয়ে গেয়ে পীড়িত মানুষজনের জন্য অর্থসাহায্য সংগ্রহ করতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এ সময়ই কলিম শরাফী যোগ দেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন, সংেেপ আইপিটিএতে। দেশের মানুষকে রাজনীতিসচেতন করে তোলার জন্য এটি ছিল একটি কালচারাল স্কোয়াড। এ সংগঠন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতে।

আইপিটিএ বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘই হয়ে ওঠে কলিম শরাফীর আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতচর্চার মূল কেন্দ্র। গান শেখা এবং গান পরিবেশনা দুটোই চলতে থাকে সমান তালে। এখানেই তার শিল্পী সত্তার পুরো বিকাশ ঘটে।   দেশের মানুষকে রাজনীতিসচেতন করে তোলার জন্য গণনাট্য সংঘের ব্যানারে তারা  দেশাত্মবোধক ও সাম্রাজ্যবিরোধী গানের পাশাপাশি পুরনো দিনের গানের অনুষ্ঠানও করতে থাকেন। সঙ্গে চলে উদ্দীপনামূলক নাটক মঞ্চায়নও। আইপিটিএর মিউজিক বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী ও কলিম শরাফী। শুভ গুহঠাকুরতা, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সংস্পর্শে কলিম শরাফী বিশেষভাবে রপ্ত করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও স্বদেশী গান। আইপিটিএর গণনাট্য আন্দোলনের জড়িত হয়ে তিনি নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, অভিনেতা-পরিচালক শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মুলকরাজ আনন্দ, খাজা আহমদ আব্বাস, রবিশঙ্কর, শান্তিবর্ধন, বুলবুল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ আলোকিত মানুষের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৬ সালে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে বের হয় কলিম শরাফীর গণসঙ্গীতের একটি রেকর্ড। তখনই নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কলকাতা বেতারে। এ সময়  কলকাতার বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’ তার গানের প্রশংসা করে ছাপা হয় একটি রিভিউ।

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর কলকাতায় আবার শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ সময় মুসলিম হওয়ার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েন কলিম শরাফী। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়েন। ১৯৫০ সালে পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি তার প্রথম স্ত্রী কামেলা খাতুন ও একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন রেডিওতে। এরই মধ্যে তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি গেয়ে পাকিস্তান গোয়েন্দা দফতরের সন্দেহের চোখে পড়েন। প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং গণজাগরণের গান গাওয়ার ফলে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখা হতে থাকে। এতকিছুর পরও কিন্তু কলিম শরাফীর গান থেমে থাকেননি।

১৯৫৭ সালে তার জীবনে ঘটে একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংযোজন। আর এটা ঘটে ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে। পূর্ববাংলায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে’ গানটির দু লাইনে কণ্ঠ দেন কলিম শরাফী। আরো একটি কারণে বছরটি তার কাছে বিশেষ স্মরণীয়। ১৯৫৮ সালে দেশজুড়ে আইউব খানের সামরিক শাসন শুরু হলে রডিওতে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হলো কলিম শরাফীর গান। একাত্তরে রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি।

‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে দু লাইন গানে কণ্ঠ দেওয়ার পরই কলিম শরাফীকে চলচ্চিত্রের নেশা খানিকটা পেয়ে বসে। ১৯৬০ সালে পরিচালনা করেন ‘সোনার কাজল’ ছবিটি। এ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। এ সময় কলিম শরাফীর সঙ্গীত পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ভেনিস’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। তারপর ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’ গানটি গেয়ে তিনি শ্রোতামহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। ‘সোনার কাজল’ ছবি পরিচালনার   সেলুলয়েডের ফিতায় জড়িয়ে পড়েন কলিম শরাফী। এতে সহপরিচালক হিসেবে ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৬১ সাল  থেকেই শুরু করেন ডকুমেন্টরি ফিল্ম তৈরি। এছাড়া শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার তার তৈরি পাপেট নিয়ে উপস্থিত হন কলিম শরাফীর ডকুমেন্টারি ফিল্মে। ১৯৬৩ সালে আবারও ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ’ চলচ্চিত্রে আবারও প্লেব্যাক করেন শিল্পী কলিম শরাফী।  

১৯৬৪ সালে ঢাকায় প্রথম টিভি সেন্টার চালু হলে কলিম শরাফী যোগ দেন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পদে। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি বেশি বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করছেন। টেলিভিশনরে চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয় তার।   ১৯৬৯ সালে শিল্পী কলিম শরাফী উদীচীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি দীর্ঘকাল ছিলেন উদীচীর উপদেষ্টা ও সভাপতি। নিজের সঙ্গীতচর্চা অটুট রেখেও ১৯৬৯ সালে ঢাকা থেকে সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, আফসারী খানম, রাখী চক্রবর্তীকে নিয়ে যান করাচিতে। তারপর গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে তাদের রেকর্ড  বের করার ব্যবস্থা করেন।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধেও সম্পৃক্ততা ছিল কলিম শরাফীর। মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে অবস্থান করে তিনি বাংলাদেশের পে গড়ে  তোলেন জনমত। গান গেয়ে, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অংশ নিয়ে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনি লন্ডন থেকে পাড়ি জমান আমেরিকায়।   সেখানেও তিনি এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। অতঃপর  দেশ স্বাধীন হলে কলিম শরাফী দেশে ফেরেন।

১৯৭৪ সালে কলিম শরাফী শিল্পকলা পরিষদের উপদেষ্টা সদস্যপদ লাভ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনে। এখানে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা ও  জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন জনাব শরাফী। এটি শান্তিনিকেতনে প্রশিণপ্রাপ্ত শিল্পীদের প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৬ কলিম শরাফী একুশে পদক পান এবং ১৯৮৮ সালে পান নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক।

১৯৯০ সালে কলিম শরাফী বেতার-টিভি শিল্পী সংসদ-এর কার্যকরী পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করায় দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাকেও আসামি করা হয়। কিন্তু এসব কোনও কিছুই তাকে তার নীতি-আদর্শ থেকে দূরে ঠেলতে পারেননি।

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কলিম শরাফী ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক অগ্রসৈনিক এবং ঐক্যের প্রতীক।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬৫০, নভেম্বর ০২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।