সেই আক্ষেপে ভুগছিলেন স্যার। কিন্তু বুধবার (১ মার্চ) বিকেলে যা ঘটলো তাতে স্যারের চোখ ছানাবড়া হওয়ারই কথা।
‘তোমাকে দেখতে যাবো যাবো ভাবছি, আর তুমি কিনা হাজির আমার কেবিনে!’ হুইল চেয়ারে বসা লাকীকে দেখে অনেকটা অবাক হয়ে এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
লাকী আখন্দের পাশে প্রথম থেকে দাঁড়ানো ‘শিল্পীর পাশে’ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক এরশাদুল হক টিংকু বলছিলেন কথাগুলো। ৪০ লাখ টাকা দিয়ে গুণী এ গীতিকার, সুরকার, গায়কের পাশে দাঁড়িয়েছিলো এ ফাউন্ডেশন।
ক’দিন ধরে লাকী আখন্দ আইসিইউতে আছেন, লাইফ সাপোর্টে আছেন, আবার কখনো মৃত্যুর গুজব পর্যন্ত ছড়িয়েছে। কিন্তু আদতে শারীরিক অবস্থা খুব ভালো না থাকলেও এর কোনোটিই হয়নি এ শিল্পীর ক্ষেত্রে। বরং বিএসএমএমইউ’র সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের (প্রশমন সেবা) অধ্যাপক নিজামুদ্দিন আহমেদের অধীনে চিকিৎসাধীন লাকী গান গাইছেন, সুর করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন।
প্রশমন সেবা হচ্ছে একেবারে জীবনের শেষ দিন গুনতে থাকা মানুষগুলোর শেষ ঠিকানা। ডা. নিজামুদ্দিন এই ইউনিটের প্রধান। দারুণভাবে ব্যস্ত রেখে শিল্পীকে শত অসুস্থতার মধ্যেও জীবনের জয়গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। বুধবার বিকেলে তিনি বলেন, বেড থেকে নিচে নামান, একটু হুইলচেয়ারে বসান, ঘোরান। সবশেষ তার কথামতো হুইল চেয়ারে বসে হাসপাতালে ঘুরলেন, সবাইকে অবাক করে দেখা করলেন অসুস্থ হওয়ার পর সবার আগে পাশে দাঁড়ানো ‘শিল্পীর পাশে’ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কেবিনে গিয়ে।
প্রায় ৭-৮ মিনিট আনিস স্যারের সঙ্গে কথা বলেন, কৃতজ্ঞতা জানান লাকী।
এর আগে বিকেলে শিল্পীকে দেখতে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মন্ত্রীকে দেখে তার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন লাকী আখন্দ। সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন। ইউনাইডেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সেখান থেকে বিএসএমএমইউতে আনার ব্যবস্থা করেন মন্ত্রী। লাকী মন্ত্রীকে বলেন, আপনি আমাকে এখানে আনার জন্য ধন্যবাদ।
দেশের একজন গুণী শিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে তাকে। প্রতিদিনের ৫-৭ হাজার টাকার ওষুধের দামও নেওয়া হচ্ছে তার কাছ থেকে। নাসিমও এসময় শিল্পীর খোঁজ-খবর নেন।
এই অসুস্থতার মধ্যে গান, সুর তাকে টেনে রেখেছে সেই যৌবনের দিনগুলো মতো। এর মধ্যে এবিএম নাজমুল হুদার লেখা ‘মমতা’ নামে একটি গানের সুর করেছেন লাকী। আর গানটি গেয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী শান্তনু বিশ্বাস। গানটির মিউজিক আয়োজন করছেন জেড এ তুষার। তবে এখনও প্রকাশ হয়নি।
টিংকুর ভাষ্যে, প্রফেসর নিজামুদ্দিনের চিকিৎসায় মুগ্ধ হয়ে লাকী বলেছেন, মৃত্যুর এই শেষ প্রান্তে এসে এই ডাক্তার আমার জীবনে যেন দেবদূত হয়ে এসেছেন।
তার কল্যাণেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে ফিরে পেয়েছেন প্রিয় গিটার, তুলেছেন সুর।
মমতা গানটি লেখা একজন মানুষের মৃত্যুর আগের প্রার্থনা, তার অনুভূতির বিস্তর জাগতিক ভাবনা নিয়ে। লাকী গানটি উৎসর্গ করেছেন এই হাসপাতালের সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের সব ডাক্তার, সেবকদের, বিশেষ করে ডা. নিজামউদ্দিনকে। এ বিষয়ে ডা. নিজামউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শিল্পীর অবস্থা একইরকম। আর গানটি আমি শুনেছি। ভালো লেগেছে। আমি খুব খুশি হয়েছি। অনেক কৃতজ্ঞতা তার প্রতি। উনি গানটি আমাকে নয়, আমাদের পুরো বিভাগকে উৎসর্গ করেছেন।
বিকেলে আরও এসেছিলেন শিল্পী আব্দুল হাদী। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেন লাকীর সঙ্গে। শোনেন তার সুর করা গানটি। শুনে মুগ্ধ হাদী তাকে বলেন, গানটি কেন আমাকে গাইতে দিলে না। পরে দু’জনে কিছুক্ষণ গানও গান।
এই গান, আড্ডা, চিকিৎসকের নিরলস ভালোবাসা আর অসীম মনের জোরই আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছে এই নীল মণিহার, আমায় ডেকো নাসহ অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা লাকী আখন্দকে।
সঠিক তথ্য না জেনে কিছু সংবাদমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করায় শিল্পীর পরিবার ও কাছেরজনেরা ভুগছেন অস্বস্তিতে। তারা অনুরোধ করেছেন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের। আর হাসপাতালে বেশি মানুষের আনাগোনাও শিল্পীর জন্য খুব স্বস্তির নয় বলে জানিয়েছেন তারা। দোয়া চেয়েছেন সবার।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৭
এএ