ঢাকা: একসঙ্গে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ৫০ বছর। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে বেদনাবিধুর হয়ে এক কোণে বসে ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর।
শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে যখন আলী যাকেরের শেষ শ্রদ্ধানুষ্ঠান হচ্ছিল, তখন আসাদুজ্জামান নূর সবাইকে এড়িয়েই চলছিলেন। টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেননি তিনি।
এরই ফাঁকে বাংলানিউজকে বরেণ্য এ নাট্যজন বলেন, আমাদের সম্পর্কটা দীর্ঘ ৫০ বছরের। আমার নাটক, আমার ক্যারিয়ার সবকিছু তাঁর হাতে গড়ে তোলা। আমাদের এই সম্পর্ক পরিবারের চেয়েও বেশি ছিল। ছটলু ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা।
একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, প্রথমে রবিউল হুসাইন, এরপর জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আজ ছটলু ভাই। গত এক বছরে এ জাদুঘরের তিন ট্রাস্টিকে হারিয়ে ফেললাম আমরা। এটা আমাদের জন্য বড় বেদনার।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রণয়, এর পর পরিণয়। তারপর এক ছাদের নীচে কেটে গেছে ৪৩ বছর। সে স্মৃতিচারণ করে আলী যাকেরের স্ত্রী নাট্যজন সারা যাকের বলেন, আমার দীর্ঘদিনের সহযাত্রী ছিলেন, সহকর্মী ছিলেন, বন্ধু ছিলেন। বাসা থেকে শেষ যখন তাকে লিফটে করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে আমাকে খুঁজছিল। তার অসুস্থতায় অনেক মানুষ পাশে ছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমার উপর তিনি কতটা নির্ভরশীল! এই নির্ভরশীলতা আমাকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেলো, যা এখন পূরণের পালা।
তিনি বলেন, আলী যাকেরের সর্বশেষ ইচ্ছা ছিল ‘গ্যালালিও’ নাটক করার। সেটা সম্ভব হয়েছে। তার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে।
দীর্ঘদিনের মঞ্চের বন্ধু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ২০২০ সাল হচ্ছে আমাদের প্রিয়জনকে হারানোর বছর। আমরাও হয়তো হারিয়ে যাবো। আজকে আমাদের মঞ্চনাটকে একটা বড় স্তম্ভের পতন হলো।
‘আলী যাকেরের মতো এত বড় মাপের অভিনেতা আমরা আর পাবো না। ‘গ্যালিলিও’, ‘নূরলদিনের সারাজীবন’ তাকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আমরা ‘প্রেমপত্র’ নামে একটি নাটক আলী যাকের ও ফেরদৌসী মজুমদারকে নিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিলাম। দুই বছর ধরে তার জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। ’
তিনি বলেন, আলী যাকের পরিপূর্ণ জীবন যাপন করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন। নাটকের দলের সংগঠক হিসেবেও চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, আমরা কি হারিয়েছি, তা ধীরে ধীরে টের পাবো। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, সহঅভিনেতা ছিলেন, সহমর্মী ছিলেন, সহযোগী ছিলেন। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন, সম্মান করতেন। যে মানুষকে আমরা হারিয়েছি হয়তো সময়ের কালে আমরা তাকে ভুলে যাবো। কিন্তু তার কথা, কাজ, অভিনয় ভুলবো না। তিনি আজ নেই, এটাই আমাদের কাছে চরম সত্য।
মামুনুর রশীদ বলেন, দুই বাংলার নাটকের একটি স্তম্ভের মৃত্যু হয়েছে। বাংলা নাটক যারা বুঝতে পারতেন, তিনি তাদেরই একজন ছিলেন। বাংলাদেশের নাটকের প্রারম্ভিককালে যে উত্থান হয়েছিল, তার পেছনে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। মঞ্চে তিনি বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে রাখতে পারতেন। বিশেষ করে নুরলদীনে তার অভিনয় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, প্রিয়জনকে মূল্যায়ন করা যায় না। নিকটজন সম্পর্কে বলা কঠিন। আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শকে ধারণ করতেন। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতেন। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজ শুরু করি, তখন আলী যাকের প্রস্তাব দিল, আমাদের যে কোনো ব্যক্তির অবদান ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত রাখবো। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে আমরা অনেক বিতর্কের বাইরে থাকতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তার স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছে।
তিনি বলেন, বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন আলী যাকের। তার সম্পর্কে অনেক কিছু সাধারণ মানুষ জানে। তবে তার বেশ কিছু না জানার মধ্যে একটি হলো, তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে ইংরেজিতে ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণী দিতেন।
নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, বাংলা মঞ্চে আলী যাকেরের চরিত্রের শেষ নেই। ‘গ্যালিলিও’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে নামভূমিকায় তার ধ্রুপদী উদাহরণ। চরিত্রকে তিনি উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে ৭৬ বছরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নাট্যজন আলী যাকের। প্রায় চার বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করেন আলী যাকের।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২০
ডিএন/ওএফবি