ঢাকা: ভালো আয় করে সন্তান-পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবেন। এমন স্বপ্ন থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন- যেন আয় করার খাতে পুঁজিটা একটু বেশি দেওয়া যায়।
কিন্তু ভালো আয় করে সন্তান-পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো দূরে থাক, সেই ঋণই শোধ করা যাচ্ছে না, উপরুন্ত মাসে তিনশ’ টাকা সুদ দিতে হচ্ছে। আর এভাবে ঋণের বোঝা ভারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে যেন তলিয়ে যাচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রহম আলী।
কথা হচ্ছিল রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে তার স্ত্রী সাথীর তৈরি করে দেওয়া ফুটপাতের বাদাম দোকানে।
বাবা নাম রেখেছিলেন ‘রহম আলী’। কিন্তু জন্মের দুই বছর পরই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে একটি চোখের আলো হারিয়ে যায় তার। এতে যেন সবার ‘চোখের বিষে’ পরিণত হন তিনি। তারপরও একটি চোখের আলোতেই চলছিল জীবন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাতরোগে বাকি চোখের আলোও নিভে যায়।
দুঃখ-বেদনার গল্প বলতে থাকেন বাংলানিউজের কাছে, ‘অন্ধ অইয়া কতো ঝামেলা। রাইতে টেয়া চিনতে বেশি সমস্যা হয়। কী করাম? পোলা-পাইনগো খাওন দেওন লাগবো। ওগো লাইগা তো ভিক্ষাও করাম পারি না’।
বলেন, ‘অখন তো কী জানি হরতাল ডাকছে। এ হরতালে দোকান লইয়া ঠিক মত বইতেও পারি না। চোখ ইডা নষ্ট তাই দেখবারও পারি না। পুলিশ শরীরে বাড়ি মারলে দোকান লইয়া দৌঁড় দেই’।
কথায় কথায় বোঝাচ্ছিলেন, যারা চোখে দেখতে পান তারা হয়তো বোমা বা ককটেল বিস্ফোরণ হলেই দৌঁড়ে পালাতে পারেন। কিন্তু অন্ধ হওয়ায় সে সুযোগটুকুও নেই রহম আলীর।
দুঃখের কথা বলেন, ‘হেই দিনকা দোকানে (ফুটপাতে) বইয়া রইছি। ধুম কইরা দুইবার শব্দ হইলো। হেরপর মানুষের পায়ের আওয়াজ। আমারে চিৎকার দিয়া কে জানি কইলো, আমার দোকানের সামনে দুইডা বোম ফাটছে। দৌঁড় না দিয়ে বইয়া রইলাম। দৌঁড় দিয়া কী করুম, বেচাকেনা করতে অইবো তো’।
দুর্বলতা থাকলেও কখনও কারও কাছে মাথা নত করেননি রহম আলী। বাদামের প্যাকেট নিয়ে দিনের বেলায় ফুটপাতে রোজগার চালালেও সে আয়ে সংসার চলে না। তাই রাতের বেলায় চায়ের দোকান চালান। তবু যদি কোনোভাবে চলে সংসার।
স্বাভাবিক দিনগুলো খানিকটা দুঃশ্চিন্তাহীন কাটলেও অবরোধ-হরতালের দিনগুলো যেন ‘গজব’ হয়ে হাজির হয় অন্ধ রহম আলীর দুয়ারে। বিএনপি-জামায়াত জোটের এবারের টানা অবরোধ-হরতাল যেন পুরোপুরি ‘গজব’ হয়ে নেমেছে তার ওপর। ক্রেতার অভাবে চরম সংকটে মুখে রহম আলীর ব্যবসা, অনিশ্চিয়তার কিনারে তার পরিবারের জীবিকাও।
বাংলামোটরের কমিশনারের গলিতে স্যাঁতস্যাঁতে ছোট্ট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে মাথা গুঁজতে গুণতে হয় মাসে পাঁচ হাজার একশ’ টাকা।
ছেলে আবদুর রহিম পড়তো তৃতীয় শ্রেণীতে। কিন্তু মা সন্তানসম্ভবা হওয়ায় ঘরের কাজ তাকেই করতে হয়। টানা হরতাল-অবরোধে আয়ও কম। তাই গত এক মা স্কুলেও যাওয়া হয়নি রহিমের।
শনিবার দুপুর ১২টায় যখন রহম আলীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনও ঘুমোচ্ছে রহিম এবং তার চার বছর বয়সী বোন তাসলিমা। সারা রাত বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে কাজ করে যেন পরিশ্রান্ত তখনও।
রহম আলীর সঙ্গে কথা বলার সময় শুনছিলেন স্ত্রী সাথী। রহম আলীর কথা শেষ হতেই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেই বলে ওঠেন, হরতাল-অবরোধ গরীব মারার। এসব না থাকলে আমরা বাদামের লগে চাল-বুটও প্যাকেট করে সংসার চালাতাম।
আয়ে ভাটা পড়ায় আর্থিক সংকটে পরিবারের নতুন অতিথির আগমন নিয়েও তাই শঙ্কিত সাথী। বলেন, ‘বাচ্চা হওনের দিন কাছেই চইলা আইলো। অভাবে ডাক্তারও দেখাইতে পারতাছি না। দুইডা মাস হইছে বাড়ি ভাড়া বাকি রইছে। এই হরতাল আরও কতদিন চলবো কে জানে?’
‘অন্ধ স্বামীডা কাম কইরা খাইতাছে, হেইডা ওগো (অবরোধকারীদের) সহ্য হয় না’-আরও জোরে বলে ওঠেন সাথী।
রহম-সাথী দম্পতির বাড়ি নেত্রকোনায়। প্রায় ১৩ বছর আগে বিয়ের পরেই ঢাকা চলে আসেন জীবিকার তাগিদে।
কিন্তু জীবিকার পথ খুঁজতে এসে এখন রাজনীতির সহিংস প্রতিযোগিতায় তারা যে অন্ধকার গলিতে ছিটকে পড়েছেন, তা থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপায় চান। বন্ধ চান রাজনীতির নামে মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতাও।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৫