ঢাকা: ভালোবাসা হচ্ছে এমনই এক শক্তি যা সব বাধা বিপত্তিকে উপড়ে ফেলে জয় করতে পারে সমগ্র পৃথিবী। বিশ্বাস, অনুভূতি আর একে অপরের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার ফলশ্রুতিতে দু’টি মানুষ এক হয়ে ওঠে।
না, তাদের মাঝে ছিলো না কোনো পারিবারিক বন্ধন, না কোনো রক্তের ঋণ। আগের জন্মে বা তারও আগে কোনো বন্ধন কি ছিলো! তবে কী এমন সুধা রয়েছে এ সম্পর্কটিতে যা একে অপরের মধ্যকার সমুদ্র সমান দূরত্ব আর পর্বত সমান বাধাকে জয় করে জন্ম দেয় আত্মার এক বন্ধনের।
আত্মার এ মিলন জন্ম জন্মান্তরের। এর বিনাশ নেই। হতে পারে না! আর তাই যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্ম হয় ভালোবাসার। ভালোবাসার মৃত্যু নেই। তার রয়েছে শুধু বিকাশ। ভালোবাসা সত্যিই অমর। সত্যিকারের ভালোবাসাই যে পৃথিবীতে সবচাইতে মূল্যবান, তা প্রমাণিত হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দীতে। এজন্য বিশ্বসেরা প্রেমকাহিনী নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন। ভালোবাসার এ মাসটিতে তাদের কথা স্মরণ না করলেই যে নয়!
প্যারিস-হেলেন
প্যারিস আর হেলেনের গল্প আমাদের সবারই জানা। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, প্যারিস ছিলেন ট্রয়ের রাজকুমার। স্বর্গের তিন দেবী হেরা, অ্যাথেনা ও আফ্রোদিতি প্যারিসকে জিজ্ঞেস করেন, তাদের মধ্যে কে সবচাইতে সুন্দরী। প্যারিস উত্তরে আফ্রোদিতির নাম বলেন। কারণ গ্রিকদের প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী এ দেবী প্যারিসকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্যারিস যদি তার নাম বলেন, তাহলে তিনি তাকে উপহার হিসেবে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী নারীকে এনে দেবেন। আর তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী ছিলেন হেলেন। যিনি স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী ছিলেন। প্যারিস হেলেনকে নিয়ে স্পার্টা থেকে ট্রয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই মেনেলাউস যুদ্ধযাত্রা করেন ও গ্রিক-ট্রয় যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
অর্ফিয়াস ও ইউরিডিস
প্রাচীন গ্রিক পুরাণে অর্ফিয়াস খুব পরিচিত একটি নাম। অর্ফিয়াসের মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীতে আকৃষ্ট হতো সবাই। এমনকি পাথর আর বনের প্রাণীরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। স্ত্রী ইউরিডিসের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তাকে যুগে যুগে অমর করে রেখেছে। এবার চলুন মূল গল্পে ফিরে যাই। ইউরিডিস সাপের কামড়ে মারা যান। অর্ফিয়াস প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পাতালপুরীতে যান। সেখানে গিয়ে অর্ফিয়াস তার সুমধুর সঙ্গীতের মাধ্যমে নরক দেবতাদের মন জয় করেন। এরপর দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে ইউরিডিসকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেন। তবে দেবতারা অর্ফিয়াসকে একটি শর্ত দিয়ে দেন, যাবার সময় তিনি যেন কিছুতেই পিছন ফিরে না তাকায়। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে অর্ফিয়াস ইউরিডিস তার পিছন পিছন আসছেন কিনা দেখার জন্য পিছনে ফেরেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ইউরিডিস অদৃশ্য হয়ে চিরকালের মতো মৃত্যুপুরীতে হারিয়ে যান।
ক্লিওপেট্রা-মার্ক অ্যান্থনি
ইতিহাসে মিশরীয় ফারাও ক্লিওপেট্রা আর মার্ক অ্যান্থনির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তাদের গল্পের শেষটা অতি করুণ। রোমানদের কাছে হেরে গিয়ে তারা দু’জনই আত্মহত্যা করেছিলেন। তখন রোমানদের শাসক ছিলেন অক্টাভিয়ান। মার্ক অ্যান্থনি ভুল তথ্য পান যে, তার প্রেমিকা ক্লিওপেট্রা মারা গেছেন। এ খবর পাওয়ার পর তিনি ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে আত্মহত্যা করেন।
অন্যদিকে, ক্লিওপেট্রা অক্টাভিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। বেশ কিছু সূত্রমতে, ক্লিওপেট্রা যখন বুঝতে পারেন যে, তিনি অক্টাভিয়ানকে কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারছেন না, তখন স্বেচ্ছায় বিষধর সাপের ছোবল খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে, ক্লিওপেট্রা ও মার্ক অ্যান্থনিকে একসঙ্গে সমাধি দেওয়া হয়েছে। তবে তা ঠিক কোন স্থানে, তা আজও একটি রহস্য।
ত্রিস্তান-ইসল্ট
দ্বাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে ত্রিস্তান-ইসল্টের প্রেমকাহিনী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসল্টের সঙ্গে ত্রিস্তানের চাচা রাজা মার্কের বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে যাবার পথে ত্রিস্তান ও রানি ইসল্ট একসঙ্গে প্রেম পানীয় খেয়ে ফেলেন। ফলে দু’জনই দু’জনের প্রেমে পড়ে যান। পরবর্তীতে ইসল্ট ত্রিস্তানের চাচাকে বিয়ে করলেও, তাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারেননি কখনওই। এদিকে ত্রিস্তানের সঙ্গে তার ভালোবাসা এগিয়ে চলে। কিন্তু একসময় তাদের গোপন প্রেম ধরা পড়ে যায় রাজা মার্কের কাছে। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও ইসল্টকে জোর করে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনেন রাজা। আর ত্রিস্তান! তিনি কর্নওয়াল ছেড়ে চলে যান আর অন্য এক নারীকে বিয়ে করেন।
তবে গল্পের শেষটা অতি করুণ। ত্রিস্তান বিষমাখা বর্শায় আহত হন। এদিকে ইসল্ট ছিলেন একজন বিশ্বসেরা চিকিৎসক। তাই ত্রিস্তান ইসল্টকে খবর দেন। তাকে নিয়ে আসার জন্য একটি জাহাজও পাঠান। ত্রিস্তান নাবিককে বলে দেন, যদি ইসল্ট আসেন তাহলে যেন সাদা পাল তোলা হয়, আর যদি না আসেন কালো পাল। ইসল্ট আসতে রাজি হন। জাহাজ যেদিন ত্রিস্তানের গন্তব্যে ফিরছিল সেদিন তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, জানালা দিয়ে দেখতে কোনো জাহাজ দেখা যায় কিনা। এদিকে জাহাজ থেকে ইসল্ট দেখলেন, জানালায় ত্রিস্তেনের স্ত্রী দাঁড়িয়ে। এতে হিংসায় তিনি ফিরে গেলেন আর নির্দেশ দিলেন জাহাজে কালো পাল তোলার। এদিকে কালো পাল দেখে ত্রিস্তান আহতাবস্থায়ই মারা যান। খবর পেয়ে ইসল্টও দারুণভাবে শোকাহত হন।
রোমিও-জুলিয়েট
ভালোবাসার গল্পে যে নাম দু’টি না নিলেই নয় তা হলো, রোমিও-জুলিয়েট। রোমিও-জুলিয়েট শেক্সপিয়ারের অসাধারণ এক সৃষ্টি। মন্টেগু ও ক্যাপুলেট নামে দুই পরিবার ইতালির ভেরোনা শহরে বাস করতো। তারা দুই পরিবারই ছিল একে অপরের শত্রু। এমনকি তাদের চাকরেরাও কেউ কাউকে দেখতে পারতো না।
মন্টেগু পরিবারের একমাত্র পুত্র রোমিও আর ক্যাপুলেট কন্যা জুলিয়েট পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে জড়িয়ে পড়লেন প্রেমের সম্পর্কে। এদিকে জুলিয়েটের পরিবার তাদের এক আত্মীয়ের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করলেন। এজন্য রোমিও আর জুলিয়েট গোপনে বিয়ে করে নেন। কিন্তু তাতেও হলো না সমস্যার সমাধান।
পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যেতে দেখে তারা এক কৌশলের আশ্রয় নেন। কৌশল অনুযায়ী, রোমিওর দেওয়া এমন একটি ওষুধ পান করবেন যাতে জুলিয়েট ২৪ ঘণ্টা মৃতপ্রায় অচেতন হয়ে থাকবেন। পরিবারের লোকেরা তাকে মৃত ভেবে সমাহিত করলে, সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনবেন রোমিও। পরিকল্পনা মোতাবেক সমাধিস্থানে গিয়ে রোমিও দেখেন, জুলিয়েট গভীর ঘুমে। তাকে মৃত ধরে নিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। এদিকে জুলিয়েট উঠে দেখেন, রোমিও না ফেরার দেশে। তিনিও প্রেমিকের আলিঙ্গনে পাড়ি জমান সেদেশে।
শাহজাহান-মমতাজ
তাজমহল নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও দু’টি নাম। দিল্লির বাদশাহ শাহজাহান ও তার রানি মমতাজ। প্রভাবশালী এ দম্পতির ভালোবাসার কাহিনী কারও অজানা নয়। মমতাজ তার ১৪তম সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে শাহজাহান শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও, মমতাজের স্মৃতি অমর করে রাখতে তাজমহল তৈরি করেন। তাজমহল তৈরির কিছুদিন পরই তার জ্যেষ্ঠপুত্র তাকে সিংহাসনচ্যুত করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। মৃত্যুর পর তাকে মমতাজের পাশেই সমাধিস্থ করা হয়।
রাধা-কৃষ্ণ
এবার আসি দুষ্টু-মিষ্টি ননি গোপালের গল্পে। যমুনা কিনারে বাঁশি বাজাতেন কৃষ্ণ। আর সেই বাঁশির সুরে উতলা হয়ে রাধার ঘরে থাকাই যেন দায় ছিল! তবে তাদের মাঝে যে প্রেম ছিল তা মূলত জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। এখানে কৃষ্ণ রাধার উপপতি বা রাধা কৃষ্ণের স্ত্রী নন। রাধা ছিলেন কৃষ্ণানুরাগী।
নেপোলিয়ন-জোসেফাইন
মহাবীর নেপোলিয়ন জোসেফাইনের প্রেমে পড়েন। জোসেফাইন প্যারিস থেকে একটু দূরে বাস করতেন। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ও রাজ্য শাসনের কাজের ভিড়ে তাদের গল্পটা একটু চাপা পড়ে ছিলো। তবে নেপোলিয়ন আর জোসেফাইনের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এর পিছনে জোসেফাইনের সন্তান জন্মদানের অক্ষমতাই মূল কারণ বলে কথিত রয়েছে।
লাইলি-মজনু
স্বর্গীয় প্রেম নামে আখ্যায়িত করা হয় লাইলি-মজনুর প্রেম কাহিনী। তাদের সম্পর্ক এতটাই দৃঢ় ছিলো যে, মজনুকে আঘাত করলে আহত হতেন লাইলি নিজেই। তবে লাইলির বাবা মজনুকে সহ্য করতে পারতেন না। তাই লাইলিকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর লাইলি মজনুর কাছে ফিরে এলেও ভীষণ কষ্টে মজনুর মৃত্যু হয়। আর সেই শোকে লাইলি নিজেও মৃত্যুবরণ করেন।
সেলিম-আনারকলি
দিল্লির সম্রাটপুত্র সেলিম আর আনারকলির গল্প আমাদের সবার জানা। কিন্তু তাদের এ সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ হন সম্রাট আকবর। লেগে যায় পিতা আর পুত্রের মধ্যে যুদ্ধ। সে যুদ্ধে সেলিম পরাজিত হন। আকবর নিজে তার পুত্রের মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু তাতে ব্যথিত হয়ে আনারকলি আকবরের কাছে সেলিমের মৃত্যুর পরিবর্তে নিজের প্রাণ বলি দেওয়ার প্রার্থনা করেন। রাজপুত্র সেলিম নিজের চোখে তার ভালোবাসাকে জ্যান্ত কবর দিতে দেখেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫