ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

জুড়ি নেই ‘কাক্কু হালিম’র

হালিম বেচে কোটিপতি শাহজাহান

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
হালিম বেচে কোটিপতি শাহজাহান ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্টে নয়। ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে হালিম বিক্রি করেই তিনি আজ কোটিপতি।

অনন্য স্বাদ আর বৈশিষ্ট্যের জন্য সাভারে হালিম রসিকদের মুখে মুখে এখন শাহজাহানের ‘কাক্কু হালিমের’ কদর।

সেই স্বাদ আর অনন্য বৈশিষ্ট্য ‘কাক্কু হালিম’কে পরিণত করেছে সাভারের ঐতিহ্যে।

‘মুখরোচক এই হালিমের স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে এই হালিমের স্বাদ। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে সীমিত আয়ের মানুষ। রুচি আর স্বাদে বিকেল না হতে সবার ঠিকানা এই হালিমের দোকান। এমন অনেকেই আছেন, কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে একটু চেখে যান আমার হালিমের স্বাদ’- বলছিলেন শাহজাহান।

বিকেলের পর ‘কাক্কু হালিমের’ ভ্রাম্যমাণ ভ্যান ঘিরে জমে যায় ভোজনবিলাসী ক্রেতাদের ভিড়। দোকান ঘিরে জমজমাট ভিড় শুরু হয় সন্ধ্যা থেকে। গভীর রাত পর্যন্ত  যেনো চলে ‘হালিম উৎসব’।

তখন ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে থাকা হালিমের দোকানটি সামাল দিতে তিন সহকারীসহ শাহজাহানের বেশ হিমশিম খেতে হয়।

এভাবেই গত ২৭ বছর ধরে সাভারবাসীকে সুস্বাদু হালিমের স্বাদ যুগিয়ে আসছেন সাভার পৌরসভার আনন্দপুরের বাসিন্দা মো. শাহজাহান (৪৮)।

গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাড়ইপুর গ্রামে। জন্মের পর শৈশব আর কৈশর বেড়ে ওঠা রাজধানীর লালবাগে। জীবনে অনেক কষ্ট করছেন। বৃথা যায়নি কঠোর পরিশ্রম। সাভার পৌরসভার আনন্দপুরে কিনেছেন সাত শতাংশ জমি। সেখানে ছয়তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে গড়ে তুলেছেন দোতলা বাড়ি।

নিজের সাফল্য নিয়ে শতভাগ সন্তুষ্ট তিনি। অকপটে বললেন, ‘পরিশ্রম, একাগ্রতা, সততা আর নিষ্ঠাই খুলে দিয়েছে সাফল্যের দুয়ার। সামান্য হালিম বিক্রেতা থেকে আজ আমি কোটিপতি’।

রাজধানীর লালবাগ কেল্লার মোড়ে ‘কাকার হালিম’ নামে বাবা মরহুম মো. হোসেন বিক্রি করতেন হালিম। সেটিও ছিলো তখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয়।

লালবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বাবার সঙ্গে হালিম বিক্রিতে নেমে পড়েন শাহজাহান। বাবার কাছ থেকেই শিখে নেন হালিম তৈরির কলাকৌশল। রপ্ত করে নেন মুখরোচক স্বাদ আনার রহস্য।

২৭ বছর আগে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে মাত্র ছয় হাজার টাকার পুজিঁ নিয়ে একটি কাঠের ভ্যান দিয়ে শাহজাহান গড়ে তোলেন ‘কাক্কু হালিম’।
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশ্বে চৌরঙ্গী সুপার মার্কটের সামনের ফুটপাতেই নানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো রয়েছে সেই ‘কাক্কু হালিম’।

বাবার জনপ্রিয় ‘কাকার হালিমের’ কদর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই বাবাকে ‘কাক্কু’ বলে ডাকতো। তাই সেই নামটিকে স্মরণে রাখতেই আমার দোকানের নাম দেই ‘কাক্কুর হালিম’। ব্যস অনন্য স্বাদ আর বৈশিষ্ট্যে জমে গেলো হালিমের ব্যবসা। জনপ্রিয় হলো আমার তৈরি হালিম। সমাজের বিশিষ্টজনরা এই ফুটপাতেই আমার হালিম খেতে আসেন। অনেকে পার্সেল করে বাড়ি নিয়ে যান। এভাবে ব্যবসার ধারাবাহিকতায় আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

নিজের ব্যবসার সূচনা নিয়ে এভাবেই অবিরত সাফল্যের কাহিনী বলে যান শাহজাহান। ‌আগে হালিম বিক্রি করতাম ২ টাকা ৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ টাকায়।

এখন ২০ টাকা থেকে শুরু হয়ে সেই হালিমের দাম উঠেছে একশ’ টাকায়। কিন্তু হালিমের স্বাদের সেই কদর এখনো রয়েছে আগের মতোই- যোগ করেন শাহজাহান।

তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে শাহজাহান সবার বড়। হালিম বিক্রি করে দুই বোন লাকি ও পাখিকে বিয়ে দিয়েছেন।

দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বড় মেয়ে সুলতানা নাজনীন সাথীকে (২২) সুশিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন।

ছেলে জাহিদুল ইসলাম ইমন (১৭) ও মেয়ে সাবিনা আক্তার নদী (১৬) বসবে এসএসসি পরীক্ষার টেবিলে।

আড়াই দশকের বেশি এই ব্যবসা জীবনে শাহজাহানের কাছ থেকে কারিগর হিসেবে হালিম তৈরির তালিম নিয়ে শতাধিক ব্যক্তি আজ তার মতোই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শাহজাহানের সেই স্বাদ আর বৈচিত্র্যের হালিম।

শাহজাহান বাংলানিউজকে জানান, হালিম তৈরির মূল উপাদান হলো রকমারি স্বাদের মসলা, বিভিন্ন রকমের ডাল, গম ও মাংস।

সকাল না হতেই প্রস্তুতি আর তোড়জোড় পড়ে যায় হালিম তৈরির। বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় গরুর মাথার মাংস আর পায়া। ডালের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে হালিম। আর পায়াগুলো থেকে তৈরি করা হয় ‘হালিমের নলি’। যার প্রতিটির দাম মাংস ভেদে ৫০ থেকে ৭০ এমনকি ৮০ টাকা পর্যন্ত।

অনেকে আবার মাটি বা প্লাস্টিকের পাত্রে পরিবারের সদস্যদের জন্য পরিমাণ ভেদে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে পার্সেল করে বাড়ি নিয়ে যান এই হালিম।

তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে রোজার মাসে ‘কাক্কু হালিম’র চাহিদা থাকে শীর্ষে। তখন চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণে।

কীভাবে বানানো হয় এই হালিম?

‘লাকড়ির চুলা জ্বালিয়ে তাতে বিশাল ডেকচিতে চাপানো হয় ছয় রকমের ডাল আর গম। সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে এ প্রক্রিয়া। চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। এর মধ্যে অন্য ডেকচিতে তেল দিয়ে আদা, রসুন, পেয়াঁজ, জয়ফল, যত্রি, গরম মশলাসহ বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে কষিয়ে এর অর্ধেক পরিমাণ ডাল আর গমের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট কষানো মশলা মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে ঘণ্টাখানেক বাদে তা অপর ডেকচিতে থাকা ডাল ও গমের সঙ্গে মিশ্রণ করে তৈরি করা হয় মজাদার কাক্কু হালিম। হালিমের স্বাদ বাড়াতে এর ওপর দেওয়া হয় সালাদ, টক ও ভাজা পেঁয়াজ’- এভাবেই হালিম বানানোর প্রস্তুত প্রণালীর বর্ণনা দিচ্ছিলেন শাহজাহান।
 
এতো হালিমের ভিড়ে কাক্কু হালিমে জনপ্রিয়তার রহস্য কি?

আসলে হালিমে ডাল-মশলার সঠিক অনুপাতই এর মজাদার স্বাদের মূল রহস্য। হেসে উত্তরটা দেন শাহজাহান। বেশ বিনয়ের সঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, আসলে হাতের যশ বলেও তো একটি বিষয় আছে। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হয়, আমার হালিমের স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ছুটে আসেন।

আমার এখানে কোনো বেঞ্চ নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ফুটপাতে তারা হালিমের স্বাদ নেন। সমাজের বিশিষ্টজনদের অনেকেই আমার হালিমের নিয়মিত ক্রেতা।

এসব মানুষদের কথা মনে করে কখনোই মানের সঙ্গে আপোস করিনি। ‘হাবিজাবি’ জিনিস মিশিয়ে দেইনি। গুণাগুণ আর স্বাদ অক্ষুণ্ন রাখতে সবসময় ভালো মানের মশলা ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মাংসসহ তরতাজা উপাদান ব্যবহার করি।

প্রতিদিন গড়ে আধামণ করে গরুর মাথার মাংস আর আর ১৩ থেকে ১৫ কেজি ডাল, গমের মিশ্রণে বিশাল ডেকচিতে তৈরি হয় কাক্কু হালিম।

সন্ধ্যার পর থেকে বাড়তে থাকে ভিড়। উপচে পড়া সেই ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় শাহজাহানদের।

শাহজাহানের এই সাফল্য দেখে পাশেই বসেছে ‘বাদশা ভাইয়ের হালিম’ নামের ভ্রাম্যমাণ আরেকটি দোকান। কিন্তু সন্ধ্যা নামতে যত ভিড় জমে কাক্কু হালিম ঘিরে।

শাহজাহান বাংলানিউজকে জানান, আগের তুলনায় বিক্রি বেড়ে গেলেও লাভ কম হচ্ছে। কারণ পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে মাংস, ডালসহ নানা উপকরণে দাম। এভাবেই গড়ে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ ক্রেতা সামলান শাহজাহান।

তবে পথ চলতি মানুষের সবারই তাড়া থাকে। তাই কেউ সময়ের একটু বেশিও অপেক্ষা করার তর সইতে চান না। বাড়তি ভিড় সামাল দিতে তখন দ্রুত হাত চালাতে হয়।

বয়স বেড়ে যাচ্ছে। আগের মতো ভিড়ের চাপ সামাল দেওয়া বেশ কষ্টকর। তাও হাসিমুখে সবার হাতে হালিম তুলে দেই। কারণ তাদের আস্থা আর সন্তুষ্টিই যে আমার প্রেরণা- বলে যান শাহজাহান।

এখন প্রতি কেজি গরুর মাথার মাংস কিনতে হয় দু’শ’ ২০ টাকায়। তা সত্ত্বেও প্রতিদিন গড়ে বিক্রি হয় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকার হালিম। সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে গড়ে লাভ থাকে হাজার টাকার মতো।

আয়ের অন্য খাত হিসেবে বাড়ি ভাড়া থেকেও শাহজাহানের মাসিক আয় ৩৯ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে আমি ভালো আছি। বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলে যান শাহজাহান।

ফুটপাতে ধুলো, বালি, ঝড় বৃষ্টিতেও কোনোদিন বন্ধ থাকে না কাক্কু হালিম। প্রতিদিনের কাঙ্ক্ষিত হালিম রসিকদের স্বাদ যোগাতে নির্দিষ্ট স্থানে হাজির শাহজাহান।

তবে বাবার পেশার ঐতিহ্য ধরে রাখলেও তিনি চান না তার উত্তরসুরীদের কেউ আসুক এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। আমার ছেলে লেখাপড়া শিখছে। আমি চাইনা ও এই ব্যবসা করুক। কারণ আমরা বহু কষ্ট আর পরিশ্রম করে এখানে এসেছি। এত কষ্ট আর পরিশ্রম ওদের মানাবে না।

তাহলে কি আপনার অনুপস্থিতির সঙ্গে কাক্কু হালিমের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে? তা কেন! হয়তো আমার সাগরেদরাই এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখবে। আর তাদের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবো আমি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।