লালমনিরহাট: বিষবৃক্ষ তামাক চাষের ক্ষতি বন্ধে নিজ জমিতে তামাকের চাষ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়ে উঠছেন সীমান্ত জেলা লালমনিরহাটের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দারা।
এরইমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় তামাকের জমিতে শুরু হয়েছে চা চাষ।
জানা গেছে, জেলার অনেক চাষি পরীক্ষামূলকভাবে তামাকের জমিতে চা বাগান করে সফল হয়েছেন। চা চাষে তামাক চাষের চেয়ে ৩ গুণ লাভ পাওয়া সম্ভব বলে তাদের মত।
তাদের দাবি, চা চাষে তামাক চাষিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, চা বিক্রির নিশ্চয়তাসহ বাজার সৃষ্টি ও চা পাতা প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ পেলে অবহেলিত এ জেলাকে চা চাষের মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।
এদিকে, তাদের দেখাদেখি ক্ষতিকর তামাক চাষ ছেড়ে চা চাষ করতে উৎসাহী হয়ে উঠছেন আরো অনেক তামাক চাষি।
সম্প্রতি একাধিক চা চাষির সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বেশি মুনাফা ও লাভের আশায় তামাক কোম্পানির নানা প্রলোভনে পড়ে তামাক চাষ করেন অনেকেই। কিন্তু এতে করে ধানসহ বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চলে যাচ্ছে তামাকের কবলে। ফলে এসব জমি হারাচ্ছে উর্বরা শক্তি। সেইসঙ্গে তামাক চাষি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যহানিসহ নানা রোগ দেখা দিচ্ছে।
এ থেকে পরিত্রাণ পেতে কৃষকরা গত কয়েক বছর ধরে তামাকের বিকল্প ফসলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। একপর্যায়ে তামাকের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে তারা নিজ উদ্যোগেই বিকল্প ফসল হিসেবে চা বাগান করতে শুরু করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় হাতীবান্ধা উপজেলার পূর্ব বিছনদই গ্রামে সোমা অ্যান্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে একটি চা পাতা প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এখানে।
সম্প্রতি সরেজমিনে হাতীবান্ধা ও আদিতমারী উপজেলার কিছু এলাকা ঘুরে ও চাষিদের সঙ্গে আলাপে এমব তথ্য উঠে আসে।
আদিমারীর সারপুকুর ইউনিয়ন তামাক চাষে জেলার অন্যতম আলোচিত এলাকা। এ এলাকায় প্রায় প্রতিটি পরিবার তামাক চাষে জড়িত।
ওই ইউনিয়নের তালুক হরিদাস গ্রামের তামাক চাষি লায়লা বানু তামাক চাষ বন্ধ করে চায়ের চাষ শুরু করে রীতিমতো হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছেন। বাড়ির পাশেই ২৭ শতাংশ জমিতে চা বাগান করে; এর আয় দিয়েই বর্তমানে দুই মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ ও সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছেন বিধবা লায়লা বানু।
তিনি জানান, তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন মারা যাওয়ার এক বছর আগেই তিনি তামাক চাষ বন্ধ করে চা বাগানটি তৈরি করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ৬ মেয়েকে নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েন তিনি। এদিকে চা বাগানের পরিচর্য়া না জানা থাকায় বাগানটি নষ্ট হতে শুরু করে। অন্যদিকে, অভাবের কারণে মাঝে-মধ্যেই নানা সম্যায় পড়তে শুরু করেন।
কিন্তু একসময় স্বামীর কথামতো (বাগান করার সময় স্বামী মকবুল হোসেন তাকে বলেছিলেন তামাক নয়, চা তোমায় বাঁচিয়ে রাখবে। ) চা বাগানের পরিচর্যায়ে মনোযোগ দেন।
শুরু হয় তার সংগ্রাম। দেশি পদ্ধতিতে প্রস্তুত শুরু করেন চা। স্থানীয় বাজারে ২০০/২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু করেন সেই চা। এভাবে প্রতি সপ্তাহে ২০ কেজি শুকনো চা প্রস্তুত করেন তিনি। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার টাকা।
তিনি জানান, সত্যিই তামাক নয়, চা বাগানটি তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বছরের ১০ মাসই চা বিক্রি করা যায় এখন। এতে তামাকের চেয়ে ৩/৪ গুণ বেশি মুনাফা পাওয়া যায়।
তবে চা পাতার বাজার সৃষ্টি ও পাতা প্রসেসিং মেশিন হলে এ অঞ্চলে তামাক সমূলে বিদায় নেবে বলেও দাবি এ নারী উদ্যোক্তার।
হাজীগঞ্জ এলাকার তামাক ছেড়ে চা চাষি আনোয়ার সরকার জানান, ধানের চেয়ে অধিক মুনাফার জন্য আগে তামাক চাষ করতেন। দীর্ঘদিন তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরা শক্তির হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া তার ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যহানি দেখা দিয়েছে। তাই তামাক ছেড়ে বিকল্প ফসল খুঁজছিলেন তিনি। গত ৩/৪ বছর আগে তিনি সিদ্ধান্ত নেন চা বাগান করার।
এজন্য তিনি প্রতিবেশী লায়লা বানার চা বাগান থেকে কাজ শিখে কয়েকটি চারা গাছ সংগ্রহ করে তামাক ক্ষেতের ওই জমিতে রোপণ করেন। গাছ বৃদ্ধির সঙ্গে স্বপ্নও বড় হতে থাকে তার। একসময় সিলেট গিয়ে চাষ চাষল উপর প্রশিক্ষণ নেন।
বর্তমানে তিনি তামাকের জমির ২০ শতাংশ জায়গায় ২ হাজার চারা গাছ রোপণ করে চা চাষক করছেন তিনি। সেই পাতা থেকে বাড়ির সদস্যদের নিয়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে চা পাতা প্রস্তুত করেন তিনি। নাম দেন সবুজ-সাথী টাটকা চা। এই চা ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন তিনি।
আনোয়ার সরকার আরো বলেন, তামাক চাষ স্বাস্থ্য ও জমির জন্য ক্ষতিকর। তামাকের চেয়ে ৩ গুণ মুনাফা পেতে চা চাষের বিকল্প নেই। এ অঞ্চলে চায়ের বাজার সৃষ্ঠি ও চা পাতা প্রক্রিয়াকরণ মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিকক অবস্থা বদলে যাবে বলে তিনি দাবি করেন।
তামাক ছেড়ে চা চাষ করা আরেক ব্যক্তি হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়া এলাকার বদিউজ্জামান ভেলু। তিনিও ২ একর জমিতে চা বাগান করেছেন। জানান, তামাকের চেয়ে অধিক মুনাফার কারণে তামাক ছেড়ে চা বাগান করেছেন। তবে তামাক কোম্পানির মতো চা কোম্পানিগুলো এগিয়ে এলে এ অঞ্চলে চা চাষ আরো বাড়বে।
পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা এলাকার তাজুল ইসলাম ও দহগ্রামের বেলাল হোসেন জানান, তামাকের তুলনায় চা চাষে খরচ অনেক কম। তবে তারা চা চাষ বৃদ্ধিতে সরকারি সহায়তার দাবি জানান।
লালমনিরহাট কৃষি সম্পসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছর জেলার ১১ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। অপরদিকে জেলার অন্তত ৭৫ জন চাষি তামাক ছেড়ে দিয়ে ২০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ করছেন। যা দিন-দিন বাড়ছে।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, এ উপজেলার জমিতে অম্লতা বেশি। যা চা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। ফলে এ অঞ্চলের অধিকাংশ তামাকের জমিতে চা বাগান করা সম্ভব।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহুরুল হক জানান, কৃষকরা চা বাগান করলে আমরা তার বাজার সৃষ্টি করব। প্রয়োজনে আদিতমারীতেই চা প্রক্রিয়াকরণ মেশিনের ব্যবস্থা করা হবে।
লালমনিরহাট কৃষি অধিদফতরের উপ পরিচালক সাফায়েত হোসেন জানান, লালমনিরহাটের মাটি ও আবহাওয়া চা চাষের জন্য যথেষ্ঠ উপযোগী। এ অঞ্চলের মাটি বেঁলে, দো-আঁশ ও অম্লতার পরিমাণ বেশি হওয়ায় চা ও কমলা চাষের জন্য উপযুক্ত।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
এসআর/