ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

বেড়িয়ে আসুন সোনারগাঁ জাদুঘর

মিজানুর রহমান মামুন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১০
বেড়িয়ে আসুন সোনারগাঁ জাদুঘর

বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্প-বাণিজ্যের মিলনমেলা হিসেবে একসময় সমৃদ্ধশালী ছিল।

এ স্থানটিতে আগমন ঘটেছিল বহু দরবেশ, সাধক ও পর্যটকের। তাদের পদচিহ্ন আজও সোনারগাঁওয়ের পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। অনুপম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন ও সবুজের সমারোহে এক অপরূপ নৈসর্গিক লীলাভূমি সোনারগাঁও।

একটা সময় যখন বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে সোনারগাঁও তার নিজস্ব ঐতিহ্যের স্মৃতিটুকু হারাচ্ছিল, তখন এখানে আগমন ঘটে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের। শিল্পাচার্য স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতায় সোনারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁও জাদুঘর)।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনবলে তৎকালীন সরকার সোনারগাঁও পানামনগরে অস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পরে এটিকে ১৯৮১ সালে পানাম নগরের কাছাকাছি শ্রী গোপীনাথ সর্দার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন প্রতিটি ঘরে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ ছিল। গ্রামবাংলার আপামর মানুষের অবসর সময় কাটত নানা উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে। তখন গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে বাউল শিল্পীদের পদচারণায় ও সুরের মূর্ছনায় মুখর ছিল। প্রকৃতির ঋতুবদলের সময় এক ঋতুর বিদায় এবং অন্য ঋতুর বরণ করে নেওয়াকে কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জের হাটবাজার থেকে শুরু করে বটমূলে জমে উঠত মেলা-উৎসব। এসব উৎসবে ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সব শ্রেণীর মানুষ শামিল হতো। মেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হতো বাউল, শরিয়তি, মারফতি, পালা গান ও পুঁথিপাঠের আসর। মেলায় বিভিন্ন কারুশিল্পীর হাতে গড়া মনোহরি বিভিন্ন পণ্য বিক্রির জন্য শোভা পেত। এর মধ্যে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, কাঠ ও মাটির তৈরি খেলনা সামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী উল্লেখযোগ্য। দুর্লভ সেসব নিদর্শন সংগ্রহ, সংরণ, প্রদর্শন ও পুনরুজ্জীবিত করাই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প প্রতিষ্ঠা করার পেছনে মূল ল্য ও উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে (সোনারগাঁও জাদুঘর) দর্শনার্থীদের জন্য মোট ১১টি গ্যালারি রয়েছে। প্রতিটি গ্যালারিতে দুর্লভ সব ঐতিহ্যের নিদর্শন সংরতি আছে। গ্যালারিগুলো হলো নিপুণ কাঠখোদাই গ্যালারি; গ্রামীণ জীবন গ্যালারি; পটচিত্র গ্যালারি; মুখোশ গ্যালারি; নৌকার মডেল গ্যালারি; উপজাতি গ্যালারি; লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন গ্যালারি; তামা, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্র গ্যালারি; লোকজ অলঙ্কার গ্যালারি; বাঁশ, বেত, শীতলপাটি গ্যালারি ও বিশেষ প্রর্দশনী গ্যালারি। এগুলো ছাড়াও ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে ফাউন্ডেশনে নতুন আরও দুটি গ্যালারি স্থাপন করা হয়। নতুন দুটি গ্যালারিকেই ভিন্নমাত্রায় সাজানো হয়। প্রথমটিতে কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শন দ্রব্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে সোনারগাঁওয়ের ইতিহাসখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা নকশিকাঁথা প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া প্রদর্শন করা হয়েছে। তাছাড়া ফাউন্ডেশন চত্বরে রয়েছে দুজন অশ্বারোহী, গরুর গাড়ির ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন লেক। ফাউন্ডেশন চত্বরে কারুপল্লী গ্রাম ও কারুশিল্প গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প নামে দুটি প্রকল্প, লাইব্রেরি এবং ডকুমেন্টশন সেন্টার রয়েছে।

কারুপল্লী গ্রামে ৩৫টি শনের ঘর রয়েছে। সেখানে দেশের নানা অঞ্চলের দ কারুশিল্পীরা বিভিন্ন কারুপণ্য সরাসরি তৈরির পাশাপাশি আগত দর্শনার্থী ও  পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।
ফাউন্ডেশন চত্বরে সর্বশেষ যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয় তার নামকরণ করা হয় সোনারগাঁও কারুশিল্প গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মূল ল্য ও উদ্দেশ্য আবহমান গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের নিজস্ব মেধায় সৃষ্ট শিল্পকলা, লোকজ ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরণ, প্রদর্শন এবং তার উৎপাদন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনধারার আলোকে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের আদলে নির্মিত প্রতিটি ঘরে স্থান পায় অঞ্চলভিত্তিক মৃৎশিল্প, কাঠ ও কাঠখোদাই, হাতে তৈরি কাগজ, শাঁখা-ঝিনুক, নারিকেল কারুশিল্পী, জামদানি শাড়ি, তাঁতবস্ত্র, শতরঞ্জি, রেশমবস্ত্র, পাটজাত কারুশিল্প, বাঁশ-বেত কারুশিল্প এবং তামা, কাঁসা ও লোহার কারুশিল্প। আর এ প্রকল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলার বৈচিত্র্যময় রূপ।
লোকজ ও কারুশিল্পের ওপর গবেষণার সুবিধার্থে এখানে লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার যোগ করা হয়েছে। লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টারটিতে রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি গবেষণাধর্মী গ্রন্থসহ পত্রপত্রিকা। লাইব্রেরিটি জাদুঘরে আসা সব দর্শনার্থী ও পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফাউন্ডেশন চত্বরে বছরে দুটি মাসব্যাপী লোকজ উৎসবসহ বিভিন্ন দিবসগুলোতে মেলা উৎসবের আয়োজন করা হয়।

মেলা প্রাঙ্গণে গ্রামীণ বিভিন্ন জীবনযাত্রার আলোকে স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে লোকজ জীবন প্রদর্শন এবং স্থানীয়দের অংশগ্রহণে গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে লাঠিখেলা, হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দা, ঘুড়ি উড়ানো, পানিতে হাঁস ধরা উল্লেখযোগ্য। লোকজ ও কারুশিল্প মেলা এবং উৎসবকে কেন্দ্র করে লোকজ মঞ্চে দিনব্যাপী আবহমান গ্রামবাংলার চিরাচরিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে। তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকজশিল্পীরা জারি-সারি, শরিয়তি-মারফতি, বাউল গান, পালাগান, হাছন রাজার গান, গায়ে হলুদের গান, বৃষ্টির গান, ঘেটু গান, আলকাপ গান, ভাওয়াইয়া গান, গম্ভীরা গান, কবি গান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গান পরিবেশন করেন।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮০৬, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।