ঢাকা: ভুল চিকিৎসা এবং অবহেলায় একের পর এক শিশু মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত পেডিহোপ হসপিটাল ফল সিক চিলড্রেন’র বিরুদ্ধে। অসুস্থ শিশুদের জিম্মি করে অভিভাবকদের থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, গত ৮ অক্টোবর থেকে পরবর্তী ১৫ দিনে ২৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে এ হাসপাতালে।
ধানমন্ডির ৬ নং রোডে ৩২/এ নং ৮ তলা ফ্ল্যাট বাড়িটি ভাড়া করে চলছে শিশু চিকিৎসার নামে এ ব্যবসা।
দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা দালাল চিকিৎসকদের মাধ্যমে রোগী সংগ্রহ করে দীর্ঘদিন ধরে নীরবে প্রতারণা করে আসছিলো হাসপাতালটি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভুল চিকিৎসায় একজন সাংবাদিকের শিশু সন্তানের মৃত্যু হলে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে মুখ খুলেন প্রতারিত হওয়া অভিভাবকরা।
গত বৃহস্পতিবার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার আলাউদ্দিন আরিফের ১০ মাস বয়সী শিশু সন্তান আরাব আরিয়ান চৌধুরীর মৃত্যু হয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলায়।
তিনি জানান, কিভাবে শিশু হাসপাতালের দালালদের মাধ্যমে পেডিহোপ হসপিটালে আসেন সন্তানকে নিয়ে।
আরিফ বলেন, বুধবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার ছেলেকে দ্রুত শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু শিশু হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় সেখান থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা পেডিহোপ হসপিটালে ভর্তির সুপারিশ করেন।
চিকিৎসকের নামেই প্রতারণা করা হয় আলাউদ্দিন আরিফের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পেডিহোপ হসপিটালে আসলে অধ্যাপক মঞ্জুর হোসেনের তত্ত্বাবধানে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে জানতে পারি অধ্যাপক মঞ্জুর দেশেই নেই।
বুধবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি হলেও ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই চালান আরিফের সন্তানের চিকিৎসা। বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালের পরিচালক ও শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ডা. আমির সোহেলের দেখা পান।
আরিফ বলেন, ডাক্তার এসে আমাকে রক্ত এবং ওষুধের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। রক্তদাতা এবং ওষুধ নিয়ে এসে শুনি আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তারপরও ওষুধ এবং রক্তদাতার রক্তের ক্রস ম্যাচিং করিয়ে অর্থ আদায় করে আমার কাছ থেকে।
পেডিহোপ হসপিটালের চিকিৎসারত এক শিশুর অভিভাবক জানান, এর আগে বুধবার রাতেও এ হাসপাতালে চিকিৎসারত আরেকটি শিশুর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু ৩ দিনের হাসপাতাল বিল ১ লাখ টাকা পূর্ণ পরিশোধের আগে শিশুর লাশ নিতে দেয়া হয়নি অভিভাবকদের।
হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ভর্তি হওয়া শিশুদের অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় প্রতারণার অভিযোগ হচ্ছে, যে চিকিৎসকের নাম বলে রোগী ভর্তি করা হয়, আসলে সেই চিকিৎসই থাকেন না হাসপাতালে।
হাসপাতালের ওই কর্মকর্তা জানান, সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতেই এখানে দালালেরা রোগী পাঠান। আর আইসিইউতে প্রথম দিন দশ হাজার এবং পরবর্তী প্রতিদিন ৬ হাজার টাকা করে বিল দিতে হয় শিশুর স্বজনদের। হাসপাতালে ১৩টি আইসিইউ বেড থাকলেও শিশু বিশেষজ্ঞদের অভাবে চিকিৎসা হয় না। এসব কারণেই গত ১৫ দিনে ২৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি।
গত ২১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু তাহমিদুলকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে রেফার করা হয়। শিশু হাসপাতালে আইসিইউ এর কথা বলে রেফার করা হয় পেডিহোপ হসপিটালে। কিন্তু এখানে এসে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাননি তাহমিদুলের মা।
ঢাকার শান্তিনগরের বাসিন্দা ফারজানা তার শিশু সন্তানকে গত ২২ দিন ধরে রেখেছেন এই হাসপাতালের আইসিইউ’তে। শিশু হাসপাতাল থেকেই রেফার করা হয়েছে পেডিহোপ এ আসার জন্য। ২২ দিনে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আইসিইউর বিল এসেছে। এছাড়াও প্রতিদিন ২ থেকে আড়াই হাজার টাকার ওষুধ লাগছে। তবে সন্তানের শারীরিক অবস্থা এখনো পুরোপুরি জানেন না ফারজানা।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, হাসপাতালটি থেকে শিশু রোগীদের সরিয়ে নিচ্ছেন তারা। শিশু মৃত্যুর এ ধরনের সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার পর ভাবিয়ে তুলেছে তাদের।
এদিকে অবহেলা ও অপচিকিৎসায় শিশু মৃত্যুর অভিযোগে বৃহস্পতিবার ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমির সোহেলকে।
থানায় বসে শিশু মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও চিকিৎসায় অবহেলার কথা অস্বীকার করেন তিনি।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এখানে মুমূর্ষু শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি করা হয়। অসুস্থাতেই মৃত্যু হয় বেশি।
তবে দালাল ধরে রোগী আনা, ইচ্ছেমতো আইসিইউ’তে রাখাসহ অন্যান্য অভিযোগের ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি ডা. আমির।
চিকিৎসকের অবহেলা এবং প্রতারণার করছে অভিযোগ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত এবং বিচারের দাবি জানিয়েছেন শিশুদের অভিভাবকেরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৩
এমএন/এনএস/আরআইএস