ঢাকা: বাংলাদেশ এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করছে। শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
করোনা নিয়ন্ত্রণের মূল স্তম্ভ হলো দু’টি। একটি হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং অন্যটি চিকিৎসা দেওয়া। মাস্ক পরা, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও দু’জন মানুষের মধ্যে তিন থেকে চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখাকে একত্রে স্বাস্থ্যবিধি বলা হয়।
করোনা প্রতিরোধে লকডাউনসহ যত রকমের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তার প্রধান লক্ষ্য হলো সংক্রমণের ধারাবাহিকতা ভেঙে দেওয়া। দীর্ঘ একবছরের বেশি সময় ধরে মানুষ করোনা মোকাবিলা করে চলছে। তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের গভীর মানসিক ক্লান্তি। ক্লান্তি ও হতাশা থেকে জন্ম নেয় এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব। একই সঙ্গে তৈরি হয় ‘যা থাকে কপালে তাই হবে’ ধরনের নিয়তিনির্ভরতা। তাই কঠোর বা কোমল কোনো ধরনের বিধিনিষেধ মানতে মানুষ একেবারে আগ্রহী নয়।
তারা খাবার জোগাড় করাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। সব সময়ই বলা হয় ‘লকডাউন’ হচ্ছে করোনা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কঠোর ধাপ বা অস্ত্র। তীব্র সংক্রমণের সময় রোগ বিস্তারের লাগাম টেনে ধরতে লকডাউন আরোপ করা হয়। তবে করোনা ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লকডাউন দিতে হলে কমপক্ষে সেটা দুই সপ্তাহের হতে হবে।
মাস্ক পরাসহ অন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের প্রবল অনীহা। মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্যবিধিতে যা করতে বলা হয়েছে তা মানুষের জন্য একেবারে নতুন। নতুন কোনোকিছুতে লোকজন সহজে অভ্যস্ত হতে চায় না। এজন্য তাকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করতে হয় এবং একই সময়ে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বাধ্য করতে হয়। এ দু’টির কোনোটাই আমাদের এখানে সঠিকভাবে পালন করা হয়নি।
এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে- ১. স্থানীয় একজন মান্যজনকে প্রধান করে প্রতিটি পাড়া, মহল্লা ও এলাকায় ‘গণতদারকি কমিটি’ গঠন করা হোক। এই কমিটি ৩-৪ জনের দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিটি বাসায় বা বাড়িতে গিয়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়োজনীতা ও বাধ্যবাধকতার কথা জানাবে। জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় যেমন করা হয়।
এরপর মাস্ক ছাড়া কেউ বাসা বা বাড়ি থেকে বের হলে তাকে ধরে বাসায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। পাড়া বা মহল্লার মানুষ সবাই সবাইকে অন্তত মুখে চেনে। বাইরের কেউ মাস্ক ছাড়া মহল্লায় বা পাড়ায় ঢুকতে চাইলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে। এ প্রয়াসের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অবশ্যই যুক্ত থাকবেন। প্রশাসন ও পুলিশ এই কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।
২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হোক। রাস্তাঘাট, শপিংমল, মার্কেট, অফিস ইত্যাদি জায়গায় কাউকে মাস্কবিহীন দেখলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। শাস্তিটা দৃষ্টান্তমূলক হবে।
করোনাক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য যা করা যেতে পারে- ১. করোনার টেস্ট সহজলভ্য করা দরকার। এজন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে প্রচুরসংখ্যক নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। সরকারিভাবে পরীক্ষার ফি বাতিল করা অতি-আবশ্যক।
২. প্রতিটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘জরুরি অক্সিজেন কেন্দ্র’ স্থাপন করা দরকার। করোনা রোগীর জন্য জীবনরক্ষাকারী একটি ওষুধ হচ্ছে অক্সিজেন। সাধারণ সিলিন্ডারের অক্সিজেন রোগীকে প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার দেওয়া যায়। এজন্য শুধু একটি বিশেষ মাস্ক ব্যবহার করতে হয়। অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি রোগীকে ১৫ লিটার/মিনিট অক্সিজেন দিয়ে সাধারণত চিকিৎসা দেওয়া যায়। যেসব হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ লাইন রয়েছে সেখানে ‘হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা’ স্থাপন করতে হবে। এই ক্যানুলা দিয়ে যন্ত্রভেদে ৬০ থেকে ৮০ লিটার/মিনিট অক্সিজেন রোগীকে দেওয়া যায়।
এতে তীব্রভাবে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রোগীর অধিকাংশকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এই যন্ত্রটি রোগীর শয্যার পাশে স্থাপন করা যায়। কিছু জটিল রোগীর জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হয়। যতোটা সম্ভব আইসিইউর শয্যা বাড়ানো দরকার। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালভেদে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার যোগান শর্তসাপেক্ষে সরকার সরবরাহ করবে।
৩. জরুরি মোবাইল মেডিক্যাল টিম গঠন করা আশু প্রয়োজন। মৃদু ও মধ্যম আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে থাকতে বলতে হবে। এদের কারো জরুরি প্রয়োজন হলে মোবাইল টিমকে ‘জরুরি বার্তা’ পাঠাবে। বাড়িতে গিয়ে রোগীকে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। প্রয়োজনে রোগীকে অক্সিজেন কেন্দ্র বা হাসপাতালে পাঠাবে। প্রয়োজন হলে রোগী নিজেও অক্সিজেন কেন্দ্রে যাবে।
৪. এরপরেও রোগীর স্থান সংকুলান করা না গেলে সশস্ত্র বাহিনী ও রেডক্রিসেন্টের মাধ্যমে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা।
প্রস্তাব করা এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে লকডাউনসহ অন্য যেসব পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষ নেবে সেগুলো অবশ্যই সফল করতে হবে।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২১
এএ