ঢাকা: ঈদ-উল-ফিতর সমাগত। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসছে ঈদ, যা বয়ে আনবে সবার জন্য অনাবিল আনন্দ।
ঈদকে উপলক্ষে সবার বাসায়ই করা হয় নানা পদের মুখরোচক খাবারের আয়োজন। রোজার এক মাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন প্রণালীতে যে পরিবর্তন আসে, সেটাতেই অনেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ঈদের সকালেই একমাসের খাদ্যাভাস বদলে সবাই সকালে নাস্তার টেবিলে বসে পড়েন। মুখে দেন সেমাই, পায়েস, জর্দা, পোলাও কোর্মাসহ আরও কত টক-ঝাল-মিষ্টি।
এবার মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে খাবার সংস্কৃতিচর্চার বিঘ্ন ঘটবেই। বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় ঘুরে ঘুরে টুকিটাকি এটা সেটা খাওয়া হয়তো হবে না। তবে নিজের বাসায় এই আনন্দের মধ্যেও আমাদের একটু নজর দেওয়া দরকার, আমরা কি খাচ্ছি, কতটুকু খাচ্ছি, বিভিন্ন খাবারের প্রতিক্রিয়া কি তার ওপর।
কি কি সমস্যা হতে পারে:
ঈদের খাবারের মূল সমস্যাটা নিঃসন্দেহে খাবারের পরিমাণে। রমজানে খাবারের সংযম হোক বা না হোক, ঈদের দিন ভুরিভোজন করা হবেই, যেন এক মাসের খাবার একদিনেই উসুল করতে হবে। অনেকেই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে হজম করতে পারেন না। নিজের ঘরে হরেক রকমের খাবারের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে গেলেই ইচ্ছা অনিচ্ছায় আরও বেশি খেতে হয়। আর এ কারণে হঠাৎ ঈদের দিনে অতিভোজনের ফলে পাকস্থলি তথা পেটের ওপর চাপ পড়ে বেশি। ফলে অধিক চাপে অনেক সময় পাকস্থলির এনজাইম ঠিকমত কাজ করতে পারে না। যদিও সাধারণভাবে কোনো নির্দিষ্ট খাবার খেতে কোনো মানা নাই, কিন্তু পরিমাণ বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। সাধারণত খাবারের মেনুতে স্বাভাবিকভাবেই মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি থাকে। ঈদের দিন প্রচুর তৈলাক্ত খাবার যেমন পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি বা গরুর গোসত, কাবাব, রেজালা, চটপটি, দইবড়া, বোরহানির সঙ্গে মিষ্টি জাতীয় খাবার আমরা সবাই খাই।
এসব খাবার পরিপূর্ণভাবে হজম করতে অন্তত ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। একসঙ্গে বেশি খাওয়ার ফলে পেট ব্যথা, পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি, ভরা ভরা ভাব, পেট ফাঁপা, জ্বালাপোড়া, বারবার ঢেকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদি হরহামেশাই দেখা যায়। যাদের পেপটিক আলসার আছে তাদের রোজা রাখার ফলে দীর্ঘক্ষণ পেট খালি থাকার জন্য নিঃসরিত হাইড্রোক্লোরিক এসিড পাকস্থলি ও ডিওডেনামে ক্ষত তৈরি করতে পারে। ঈদের দিন তৈলাক্ত ও ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ায় পাকস্থলী ও ডিওডেনামের ক্ষতে পুনরায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়। আইবিএস বা ইরিটেবল বা ওয়েল সিনড্রোম রোগে যারা ভোগেন, তাদের সমস্যাটা আরও বেশি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দুগ্ধজাত খাবারগুলো যেমন পায়েস, সেমাই, হালুয়া ইত্যাদি খাবারে অস্বস্তি, ঘন ঘন মলত্যাগ ও অসম্পূর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি হয়। আবার অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। যাদের অ্যানাল ফিশার ও পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি আগে থেকেই আছে, তাদের এ সমস্যা আরো বেশি প্রকট হয়। যাদের হিমোরয়েড বা পাইলসের সমস্যা আছে, তাদের পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে।
কি করবেন:
ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সেমাই, পায়েস, এগুলোর সঙ্গে কিশমিশ, বাদাম, ফলের জুস, যেমন পেঁপে, আম ইত্যাদি খেতে পারেন। খাবার আধ ঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন। দিনে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া ভালো। একবারে বেশি করে না খেয়ে অল্প অল্প করে বার বার খাবেন। যারা ঈদের দিন চটপটি জাতীয় খাবার পছন্দ করেন, তারা তেঁতুলের টক মিশিয়ে খেতে পারেন। পোলাও বা বিরিয়ানির সঙ্গে অবশ্যই সালাদ জাতীয় খাবার এবং দই খেতে পারেন। বয়সের তারতম্য অনুসারে এবং কেউ কোনো বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগেন কিনা সেসব বিবেচনা করে খাওয়া-দাওয়া গ্রহণের ব্যাপারে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।
ছোট শিশুদের ঈদ আনন্দটা সবচেয়ে বেশি। তারা শখ করে দুই-একটা রোজা রাখে, রোজা শেষে ঈদের দিন মজার মজার খাবার খেতে বেশি পছন্দ। তবে, অতিভোজনে যে কারো মতো ছোটদেরও সমস্যা হতে পারে। যেকোনো কিছু্ খেলেই সবসময় শরীরে সমস্যা হবে এমন কথা নেই। শুধু পরিমাণটা ঠিক রাখলেই হলো। কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলে হজমে সহায়ক সব ধরনের এনজাইম সঠিকভাবেই কাজ করে। এমনকি গুরুপাক তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাদ্যগুলো সহজে হজম হয়ে যায়। তবে অবশ্যই অতিভোজন না করাই ভালো।
তরুণ-তরুণীদের শারীরিক কোনো সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন এবং তাদের হজমেরও কোনো সমস্যা হয় না, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো। তবে অনেকে একমাসের অনভ্যাসের কারণে হঠাৎ খুব বেশি ঝাল বা তৈলাক্ত বা ভাজাপোড়া খেলে অসুস্থবোধ করতে পারেন। তাই সবার জন্যই খাবার হওয়া উচিত কম মসলাযুক্ত, কম তৈলাক্ত, ভালোভাবে রান্না করা। পানি, শরবত, ফলের রস ও অন্য তরল খাবার বেশি করে গ্রহণ করুন, এতে গুরুপাক খাবারের জন্য পেটে স্থান কমে যাবে।
মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক মানুষের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন। এমনকি উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাইপারকোলেস্টেরমিয়া ইত্যাদি রোগ না থাকা সত্ত্বেও এই বয়সের মানুষের ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা উচিত। যাদের রক্তের কোলেস্টেরল বেশি, যারা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস রোগে ভোগেন, অথবা যারা মুটিয়ে যাচ্ছেন, তারা খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক হবেন।
ডায়াবেটিক রোগীকে অবশ্যই মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং সবজি বা টক ফল খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন। এগুলো আপনাকে অন্য খাবার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে। নেহায়েত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নিবেন। পোলাও-বিরিয়ানি কম খাবেন। মুরগি বা গরুর মাংস খাওয়া যাবে যদি অতিরিক্ত তেল বা চর্বি না থাকে। খাবারের পরিমাণটা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা এসব খাবার একবেলাই খাওয়া উচিত, অন্য বেলা স্বাভাবিক খেতে হবে। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এদিন একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, প্রয়োজনে ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা একটু বাড়াতে হতে পারে। এ ব্যাপারে ঈদের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন মাছ-মাংস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দিনে দুই টুকরোর বেশি নয়। ফল খাবার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা থাকে। তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত ঈদের আগেই।
ঈদে অতিরিক্ত খেয়ে পেট জ্বালা করা, ফাঁপা আর পেপটিক আলসার খুব সাধারণ সমস্যা। যাদের পেটের এই সমস্যা আছে তারা অতিরিক্ত ঝাল, মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করবেন। দুইবেলা খাবার আধঘণ্টা আগে আলসারের ওষুধ যেমন ওমেপ্রাজল, ইসমিপ্রাজল, ইত্যাদি খেয়ে নেবেন। প্রয়োজনে খাবার পর দুই চামচ এন্টাসিড খেতে পারেন। পেট ভরে খাবেন না, গোগ্রাসে না খেয়ে সময় নিয়ে চিবিয়ে খাবেন, খাবার সঙ্গে সঙ্গে পানি না খেয়ে একটু পরে খাবেন, রাতে খাবার পর পরই ঘুমাতে যাবেন না, কিছুক্ষণ হাঁটা-চলা করতে পারেন, দুই-তিন ঘণ্টা পর ঘুমাবেন। যাদের আইবিএসের সমস্যা আছে তারা দুধ এবং দুধের তৈরি যেকোনো জিনিস যেমন দই, মিষ্টি, ছানা, মাখন, ফিরনি এগুলো পরিহার করবেন।
ঈদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। একে রোজায় পানি কম খাওয়া হয়, সবজি কম খাওয়া হয়, ভাজা পোড়া খাওয়া হয় বেশি। ঈদেও সেই ধারা বজায় থাকে, এছাড়া মাংস, তেল, চর্বি বেশি খাওয়ায় পানির অভাব আরও বেশি দেখা দেয়। ফলে অনেকেই বিশেষ করে বৃদ্ধরা সমস্যায় পড়েন। এক্ষেত্রে ঈদের আগের রাতে বা ঈদের সকালে ইসবগুলের ভুষি খেয়ে নিতে পারেন। সকালে ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সেমাই পায়েসের সঙ্গে ফলের রস খেতে পারেন। এর সঙ্গে প্রচুর পানি পান করবেন। ঈদের দিন দুপুর ও রাত্রে অবশ্যই সবজির একটি পদ রাখবেন। আর সব খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি বা অন্যান্য পানীয় পান করতে ভুলবেন না। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা প্রকট হলে প্রয়োজনে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করবেন।
ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। ঈদে তাই সবার জন্যই থাকে একটু অন্য রকম মজাদার খাবার। খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে মনে রাখতে হবে, খাওয়াটা যেন হয় ভেজালমুক্ত, টাটকা, স্বাস্থ্যসম্মত, সহজপাচ্য এবং উপাদেয়। অবশ্যই হতে হবে পরিমিত এবং পরিকল্পিত। অতি ভোজনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই শরীরটা এবং মনটাও সুস্থ থাকবে সবসময়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, অতিভোজন এমনকি স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়ার ফলেও যদি শারীরিক সমস্যা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইউজিসি অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সৌজন্য: বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২১
এএটি