ঢাকা: আট দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হিমালয়কন্যা নেপালে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।
মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশিল কৈরালাএৈ আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
শনিবার (২৫ এপ্রিল) নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতে একযোগে আঘাত হানে শক্তিশালী এই ভূমিকম্প। উৎপত্তিস্থলে রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৯।
মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস’র তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল কাঠমাণ্ডুর অদূরে পোখরার কাছে লামজুং। এর ২৬ মিনিট পর দ্বিতীয় এবং ৮ মিনিট পর তৃতীয় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। এরপর পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় বিভিন্ন মাত্রার পঞ্চন্নটি কম্পন অনুভূত হয় বলে স্থানীয়দের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় সংবাদমাধ্যম।
মূল ভূমিকম্প পরে রোববার (২৬ এপ্রিল) দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতে আবারো একটি নতুন ভূমিকম্প আঘাত হানে। ইউরোপীয়-ভুমধ্যসাগরীয় সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের (ইএমএসসি) হিসাবে রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫। তবে ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য মতে, এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭।
নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে ৮৫ কিলোমিটার পূর্বে ও কোদারি থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল বলে জানিয়েছে ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে।
এরপর সোমবারও (২৭ এপ্রিল) ভূকম্পনে কেঁপে ওঠে নেপাল। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্যমতে এই কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ১।
এ নিয়ে গত তিন দিনে প্রায় ৬০টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত নেপালে।
এর আগে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের প্রভাবে আগামী ‘কয়েক সপ্তাহ’ ধরে নেপালে আরও বেশ কয়েকটি ভূকম্পনের আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে।
রোববার (২৬ এপ্রিল) যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ব্রায়ান ব্যাপ্টি বলেন, মূল আঘাতের পর ভূমিকম্পের প্রভাবে আরও কয়েকটি মৃদু কম্পন হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। শনিবারের (২৫ এপ্রিল) আঘাতের পর আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে এর প্রভাবে আরও বেশ কয়েকটি ভূকম্পন আঘাত হানতে পারে নেপালে।
এসময় তিনি ভূকম্পন পরবর্তী আঘাতগুলোর মাত্রা রিখটার স্কেলে সাড়ে ছয় ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নেপালে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার তিনশ’ ১০ জনে। দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার প্রধান রামেশ্বর দাঙ্গাল সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, সোমবার (২৭ এপ্রিল) রাতেও তৃতীয় দিনের মতো খোলা আকাশের নিচে কেটেছে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালের বাসিন্দাদের। রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে হাজার হাজার মানুষ তাঁবু টাঙিয়ে রাত পার করেছেন। এদের অধিকাংশের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বাকিরা ঘরে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন বলে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঠিক চিত্র এখনো জানা যাচ্ছে না।
ভূমিকম্পে কাঠমাণ্ডুর অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। ভূমিকম্পের পরের নেপালকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকের মৃতদেহ মিলছে। উদ্ধারকর্মীরা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন। তবে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় উদ্ধার অভিযানে সময় লাগছে।
এদিকে, কাঠমাণ্ডু মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা তাঁবুতে অপারেটিং থিয়েটার তৈরি করে আহত মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছেন।
ভারতে নেপালের রাষ্ট্রদূত দিপ কুমার উপাধ্যায়া বলেন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আর স্থানের সংকুলান হচ্ছে না। আহতদের খোলা জায়গায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নেপালের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মিনেন্ডা রিজাল বলেন, আমরা মহাদুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রচুর সাহায্য ও সমর্থন দরকার।
অত্যন্ত নাজুক এ মানবিক পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য চেয়েছে নেপাল সরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নেপালের ডাকে সাড়া দিয়ে দ্রুত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ দল পাঠিয়েছে। প্রাথমিক সহায়তা হিসেবে তারা ১০ লাখ ডলার সাহায্য দিয়েছে। ভারত হেলিকপ্টার, মোবাইল হাসপাতাল, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ৪০টি শক্তিশালী উদ্ধারকর্মী দল ও ডগ স্কোয়াড পাঠিয়েছে।
চীন ডগ স্কোয়াডসহ ৬২টি উদ্ধারকর্মী দল পাঠিয়েছে। পাকিস্তান চারটি এয়ারক্রাফট, ৩০টি হাসপাতাল শয্যা, সেনাবাহিনীর চিকিৎসক দল, খাবার, তাঁবু ও কম্বল পাঠাচ্ছে। যুক্তরাজ্য আটটি সাহায্যকারী দল ও ৫০ লাখ পাউন্ড সাহায্য পাঠিয়েছে। এছাড়া জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ইসরায়েল ও স্পেনের কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
এদিকে, ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সহযোগিতা সংস্থা (আসিয়ান)। দশ দেশের এই সংস্থা প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত দেশগুলোর উদ্দেশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।
সোমবার (২৭ এপ্রিল) মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে তিন দিনব্যাপী আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে এক বিবৃতিতে আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ কথা জানান।
এর আগে, ১৯৩৪ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্প আঘাত হানে নেপালে। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে নিহত হয় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এছাড়া, ১৯৮৮ সালে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হিমালয়কন্যা। সেবার সাতশ’ ২২ জন নিহত হয় দেশটিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৫
আরএইচ