কাঠমান্ডু (নেপাল) থেকে: কাঠমান্ডু শহরে ৩৬ দেশের সহযোগিতায় উদ্ধার-ত্রাণে যে তৎপরতা, তার রেশমাত্র নেই অদূরের গ্রামগুলোতে। পাহাড়ের গা-বেয়ে গড়া নিম্বুগাঁও ভেঙে এখন ঝুরঝুরে, আর ধর্মস্থালী যেন দুঃস্বপ্নের কোন ভূতুডে রাজ্য!
এই গ্রামের সর্বহারা মানুষগুলো নজরের বাইরে রয়েছে বিধ্বস্ত হওয়ার এত দিন পরও।
ভেঙে ঝুরঝুরে নিম্বুগাঁও:
নিম্বুগাঁও যাওয়ার আগে সেখানে বসবাসকারী ও ক্ষতিগ্রস্তের হিসেবটা জানতে চেয়ে নিরাশ হতে হয়েছে। কারণ হিসেবটি করা হয়নি কারও। প্রায় আধঘণ্টা গাড়িতে চড়ে এবং সাত মিনিট পায়ে হাঁটার পর চোখে পড়ে পাহাড়ি গ্রাম নিম্বুগাঁও। রাজধানী কাঠমান্ডু ও নোয়াকোটের মাঝামাঝিতে এই গ্রামের অবস্থান।
একটু এগোতেই দেখা মেলে গ্রামের মাতুব্বর তেগবাড় বালামির। আলাপ-চারিতায় তিনি জানালেন, ভূমিকম্পের প্রথম ধাক্কায় মারা গেছেন এই গ্রামের পাঁচজন। সব মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার মানুষের বসবাস এই গ্রামে।
ভয়াবহ ভূকম্পনে তার ছোট দোতলা বাড়িটিও গুড়িয়ে গেছে বলে জানালেন তেগবাড়।
ভাঙা বাড়ি আর ‘বিক্ষত’ পরিবেশে দিনাতিপাত করলেও এখনও পর্যন্ত সরকার বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা মেলেনি এই গ্রামের মানুষের ভাগ্যে।
গ্রামের নেতা তেগবাড় বালামি বলেন,এখানে সরকার বা কোনো এনজিও এর পক্ষ থেকে সহযোগিতা বা পরিদর্শনেও আসেনি কেউ।
পাহাড়ি গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ইটের তৈরি ছোট ছোট বাড়িগুলোর ধ্বংসস্তুপ পড়ে আছে। এখানকার প্রায় ৫শ’ বাড়ির সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৩শ’টি বাড়ি পুরোপুরিই মাড়িয়ে দিয়েছে ভূমিকম্প।
পাহাড়ের উপরে গ্রামের মাঝামাঝি একটু খালি জায়গা রয়েছে। সেখানে খোলা আকাশের নিচে গত ২৫ এপ্রিল থেকে রাত যাপন করছেন বিপর্যস্ত গ্রামের বাসিন্দারা।
ধ্বংসস্তুপে নুয়ে পড়া কোনো ঘর থেকে একটি খাট বের করে আনতে পারলেও রোদ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে তাবু কিংবা ত্রিপলের ব্যবস্থাটুকু করতে পারেননি দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত গ্রামবাসী।
গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ অমর বালামি, নুনু বালামি, চন্দ্র বালামি ধরেই নিয়েছেন- তাদের কেউ নেই, কেউ তাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসবে না।
অনেকটা অভিমানের সুরে অমর বললেন, ‘সরকার পয়সাওয়ালা লোগোকো লিয়ে! হামিসে কোয়ি কাম নেহী হ্যায় উসকা!’
‘সবকুছ তো মিল গ্যায়া মিটটি মে। আভি ইয়ে দিন দেখনে কি র্যাহগায়া থা ইস উমরমে,’ তার সঙ্গে যোগ করে বলেন নুনু বালামি।
আর চন্দ্র বলেন,‘উস দিন ঘর পর নেহী থে হাম। ক্ষেতমে কামে থে। উস ওয়াক্ত অ্যায়সা হো গায়া। ’ এ সময় হাত উচিয়ে ভাঙা ঘরটি দেখালেন তিনি।
ভয়াবহ দুর্যোগে ভেঙে গেছে মনুমায়া বালামির দোকানটিও। বললেন, দুকানতো টুট চুকা। জো সামাল আভি হ্যায়, ও বিক যায়, তো ঘর চলেগা।
ধর্মস্থালী যেন ভূতুড়ে রাজ্য!
গাড়ি থেকে কিছুটা আগেই নেমে গেলাম। প্রায় ১২ মিনিট পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে পাওয়া দেখা পেলাম ধর্মস্থালী গ্রাম। গ্রামটি দেখে বারবার মনে হচ্ছিল-সত্যিকারের ‘ডেথ ভ্যালি’ বলতে হয়তো এমনটিই বোঝায়!
গ্রামের চার-পাঁচতলা বাড়িগুলোর প্রতিটিই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি হিসেবে এখানে ১৪ জন মারা গেছেন। কিন্তু ধ্বংসাবশেষের ভয়াবহতায় সেই হিসেব যেন বেশ কমই মনে হয়!
গ্রামে হেঁটে এগাতেই নাকে দুর্গন্ধ আসে বলেই হয়তো হিসাবটিকে আরও বেশি অবিশ্বাস্য মনে করছেন গ্রামবাসীরা।
পাহাড়ি গায়ের পথ ধরে আরেকটু উপরে উঠলেই খানিকটা খালি জায়গার দেখা। সেখানে তাবু টাঙিয়ে কোনো মতে দিনাতিপাত করছেন কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা।
যে সামান্য জিনিসপত্র রক্ষা হয়েছে, সেগুলো ভাঙা বাড়ি থেকে বের করে তাবুর নিচে রেখেছেন তারা।
তবে একে তো পাহাড়ে, রয়েছে ঝড়ো হাওয়া! ঠাণ্ডা বাতাসে এই গ্রামে টেকাই যেন মুশকিল। একটুখানি উষ্ণতার জন্য অনেকে তাবুর সামনে আগুনও ধরিয়েছেন, তবে তাতে যেন বাতাসের আক্রোশ, নিভিয়ে ফেলতে চায় বারবার।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ আঁধার নামে গ্রামে, আকাশের চাঁদটিও স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু সেই চাঁদে ধর্মস্থালীর অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়! ভূতুড়ে সুনশান গ্রামটি যেন গা ছমছম করিয়ে দেয়!
ইট-পাথরের স্তুপে চোখে পড়ে কোনো নারীর এক পাটি স্যান্ডেল, ছোট শিশুর দুধের বোতল, একটি টেবিল ফ্যান, ছাতা! চোখে পড়ে একটি তুলতুলে বালিশও। মন্দিরের ঘণ্টাও রয়েছে অবিকল আগের মতোই।
স্থানীয়দের পোশাক-পরিচ্ছদ ও পাহাড়ি বাড়িগুলোর নকশা দেখে মনে হয়, হিমালয় কন্যা নেপালের পাহাড়ি গ্রামগুলোর মধ্যে ধর্মস্থলী ছিল বেশ উন্নত। ক্ষতিও হয়েছে কম নয়।
বাংলানিউজকে স্থানীয় মধুসূদন জানান, এই বাড়িগুলোর প্রায় ৪ হাজার বাসিন্দা ছিলেন। এখন কোনো বাড়িতেই কেউ থাকছেন না। সবাই গ্রামের অদূরে খোলা জমিতে তাবু গেড়ে সময় পার করছেন।
এই ‘আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পন’ তাকেও ঘরহারা করেছে বলে জানালেন তিনি।
গ্রামের লোকজন বলেন, তাদের কোনো অভিযোগ নেই। কয়েকজন আবার এও বললেন, সরকারের পক্ষ থেকে এখানে কেউ আসেনি। তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে ত্রাণ ও তাবু পেয়েছেন তারা।
দিনের কড়া রোদ, রাতের ঠাণ্ডা বাতাস; এরমধ্যে ঝড়-বৃষ্টি তো রয়েছেই। এসব সয়েই দুযোর্গ মোকাবেলা করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ‘বাস্তুহারা’ এসব মানুষ।
মুখে অসহায়ত্ব আর কষ্টের ছাপ থাকলেও চোখে কান্না নেই, শুধুই যেন বাঁচার আকুতি।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২২ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৫
এসকেএস/এমএ
** দরবার স্কয়ার এখন তাবুর স্কয়ার
** বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই নাকে লাশের গন্ধ
** সাজেদা সুইটি এখন কাঠমান্ডুতে
** বিপন্ন নেপালে যাচ্ছেন সাজেদা সুইটি
** বিমানের কাঠমান্ডু ফ্লাইট বিলম্বিত