পশুপতিনাথ মন্দির (নেপাল) ঘুরে: নেপালের পশুপতিনাথ মন্দিরের ভিড় যারা দেখেছেন তাদের অবাকই হতে হবে এর বর্তমান চিত্রে। ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পে কয়েক অংশ ভেঙে নিস্তব্ধ এ মন্দিরের ভিড় এখন কেবল চিতাঘাটেই।
পশুপতিনাথ মন্দিরের এ চিত্র নেপালের বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক চিত্রই যেন তুলে ধরছে। কারণ নেপালের অর্থনীতিতে এ মন্দিরকেন্দ্রিক কার্যক্রম বিরাট অবদান রাখছিল বলে সংশ্লিষ্টরা অবগত।
রোববার (০৩ মে), দুপুরের কড়া রোদে জুতা খুলতেই তপ্ত মেঝে যেন পা পুড়িয়ে দিতে চায়। ঘুরে ঘুরে পুরোটিতে স্বাভাবিক চিত্র একদমই পাওয়া গেল না। পর্যটক নেই, প্রার্থণায় আসা মানুষের কোন সমাগম নেই। সুনসান নীরবতা সর্বত্র।
মন্দিরের পূজারি ও অন্যদের কাছ থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের পর এখানে আর সেভাবে কেউ আসছে না।
মন্দিরে ঢোকার পথে শিভে নামের এক যুবককে দেখা যায় গিটার বাজিয়ে গান গাইতে, ‘নেপালীলাই নেপালীবাই মায়া গারিয়ে (নেপালীদের জন্য নেপালী ভাইয়েরা মমতা করুন’।
তার সুরেলা কণ্ঠ মন্দিরের পরিবেশ যেন আরও বেদনা বিধুর করে দেয়।
যে অংশগুলো ভেঙে পড়েছে, হাতে গোনা আগন্তুকরা দেখছেন দাঁড়িয়ে।
মন্দিরের মূল জায়গাটিতে (যেখানে পশুপতির (ষাঁড়) বিশাল সোনালী মূর্তি, রাজার মূর্তি) যেন আরও শীতল নীরবতা।
সফর সঙ্গী নেপালের বেসরকারি টেলিভিশন নেপাল ওয়ানের রিপোর্টার ও উপস্থাপক কবিতা। তিনি জানালেন, সচরাচর বিদেশি পর্যটকদের এখানে ঢুকতে ২০ ডলার পরিশোধ করতে হয়। তাও হিন্দু ছাড়া অন্য কোন ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার নেই ভেতরের বিশেষ সম্মানের অংশটিতে। কোন ক্যামেরার এখানে প্রবেশ বা ছবি নেওয়া শাস্তিযোগ্য কাজ। অবাধ্যরা ধরা পড়লে ক্যামেরা হারাবেন।
অপর সঙ্গী আয়ুশ ঘিমিরে নেপালের সরকারি টেলিভিশন নেপাল টিভি’র রিপোর্টার ও প্রেজেন্টার মনীষা ঘিমিরের কিশোর ছেলে।
অবাক হতে দেখে আয়ুশ হেসে বলে, তোমাকে হিন্দু পরিচয়ে ভেতরে এনেছি, তারা (মন্দির কর্তৃপক্ষ) জানতে পারলে আমার মাথাটা শরীর থেকে নামিয়ে দেবে।
কবিতা বলেন, নেপালী হয়েও অন্য সময় ভিড়ের কারণে পুরো মন্দির, এর কারুকাজগুলো এভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। এভাবে কখনো এ মন্দির দেখবো ভাবিনি।
বারান্দার মতো জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে চিতাঘাট চোখে পড়ে। লাশ পোড়ানো হচ্ছে, ধোঁয়া উঠছে।
সেদিকে এগোতে কবিতা জানান, ভূমিকম্পের পর এখানে প্রতিদিন অনেকগুলো শবদাহ হয়। যাবতীয় ব্যয় সরকার বহন করছে। অন্য সময় এখানে ৭/৮ হাজার রুপি (নেপালী মুদ্রা) খরচ পড়ে প্রতিজনের দেহদাহে। কিন্তু এখন সরকার কাঠ ও যাবতীয় সামগ্রী বিনামূল্যে দিচ্ছে।
একের পর এক লাশ পুড়ছে, ধোয়াঁ ও মানবদেহ পোড়ার গন্ধ মাস্ক ভেদ করে ভেতরে ঢোকে, গা ছমছম করে ওঠে, গুলিয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে মনে শোক জাগে।
একটু পরেই কান্নার শব্দ, এক নারী চিৎকার করে কাঁদছেন। তার ছেলে মারা গেছে। কিছুতেই ছেলের মৃত্যু মেনে নিচ্ছেন না এ মা, বিশ্বাস করছেন না। তাকে চিতাঘাটে আনাতে কষ্টে তার বুক ফাটছে।
একটি খাটিয়ায় একটি মৃতদেহ নিয়ে এল চারজন ব্যক্তি। সঙ্গে এক তরুণী বালিশ ও বিছানা নিয়ে কাঁদো চেহারায়।
তরুণীর নাম তুলসা। তুলসার বাবা রুইনিকুমার ভূমিকম্পে আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। রোববার মারা গেলেন। শোকাতুর তুলসা এর বেশি কথা বলতে পারলেন না।
একদিকে কাঠ সাজানো হল, পাশেই তুলসার ভাইয়ের মাথার চুল ফেলে দেওয়া হল ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী।
এসব দেখার মাঝেই চোখে পড়ে দুই নারী, মালা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন।
তাদের নাম সানু ও মাইরা।
আলাপে জানান, এ থেকেই ঘর চলে। কিন্তু পর্যটক নেই বলে ব্যবসা হয় না।
কাজ চলার মতো ইংরেশি শিখে নিয়েছেন সানু। বিদেশি দম্পতি দেখে ছুটে গিয়ে মালা বিক্রি করতে চান।
বিফল হয়ে নিরাশ হয়ে ফেরেন, বলেন, ‘বিকতি নেহী আব। আব কোয়ী গালেমে নেহী প্যাহেনতে মালয়। ভূচাল সবকুছ লে গ্যায়া হামারা, ব্যাপারভি (বিক্রি হয় না এখন। কেউ এখন মালা গলায় পরে না। ভূমিকম্প আমাদের সব কিছু নিয়ে গেছে, ব্যবসাও। ’
মন্দিরে পূজা দিতে আসা শিবসুন্দর জানান, ভূমিকম্পে মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ভেঙেছে, তবে সেভাবে কোন মানুষের এখানে ক্ষতি হয়নি।
‘এক আদমিকা খুটা ভাজ গায়া(একজন লোকের পা ভেঙেছে)’- বলেন শিবসুন্দর।
কবিতা বলেন, এই মন্দিরে ২৪ ঘণ্টা ভিড় থাকতো। প্রবেশ ফি, চিতার খরচ থেকে শুরু করে এটিকে কেন্দ্র করে সুন্দর একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু এখন সবটুকু নষ্ট হয়ে গেছে। জানি না, কত সময় লাগবে আগের অবস্থা পেতে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৫
এসকেএস/জেডএম
** আড়ালেই ঝুরঝুরে নিম্বু-ভূতুড়ে ধর্মস্থালী
** দরবার স্কয়ার এখন তাবুর স্কয়ার
** বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই নাকে লাশের গন্ধ
** সাজেদা সুইটি এখন কাঠমান্ডুতে
** বিপন্ন নেপালে যাচ্ছেন সাজেদা সুইটি
** বিমানের কাঠমান্ডু ফ্লাইট বিলম্বিত