ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাংলানিউজকে মেজর শাকিল

নেপাল-চিত্রে ঢাকার অশনিসংকেত

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৫
নেপাল-চিত্রে ঢাকার অশনিসংকেত ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বসুন্ধরা (নেপাল) থেকে: ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পে নেপালের যে ক্ষয়ক্ষতি, ঢাকায় এমন ভূমিকম্পে তা হবে কয়েকগুণ বেশি। জনসংখ্যা ও স্থাপনার ঘনত্ব, খোলা জায়গার স্বল্পতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ ব্যবস্থায় ত্রুটিই হবে সে ক্ষয়ক্ষতির মূল কারণ।


 
নেপাল ঘুরে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এমন আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর এটিএম শাকিল নেওয়াজ  খান।
 
৩ মে তিনিসহ ফায়ার সার্ভিসের ৫ জনের একটি টিম বাংলাদেশ থেকে নেপাল এসেছে। সরকারের অনুমতিতে নেপালকে সহযোগিতা দিতে আরও আগেই তাদের আসার কথা ছিল। কিন্তু এদেশের সরকার পরে সেটির প্রয়োজন নেই বলে জানায়।

বাংলাদেশের দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেপালের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যাবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতিতে তারা এসেছেন বলে জানান শাকিল। নেপালে বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয়ও করছেন তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপে।
 
দূতাবাসে বসেই বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে নেপাল ও ঢাকার পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র এবং করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন তিনি।
 
শাকিল বলেন, নেপাল আমাদের কেন আসতে নিষেধ করেছিল- ঠিক জানি না। তবে এলে ভালো হত। আমরা ভূমিকম্প ঠেকাতে পারি না, তবে ক্ষতি কমাতে পারি। রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের সহযোগিতা করতে পারতাম। শত শত মানুষকে উদ্ধার করার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে।
 
তিনি বলেন, এসব ঘটনায় উদ্ধারকাজে প্রথম আধাঘণ্টা ‘গোল্ডেন টাইম, প্রথম ২৪ ঘণ্টা ‘গোল্ডেন ডে’। যত সময় পার হতে থাকে ততই বিপদ বাড়তে থাকে। জীবিত উদ্ধারের আশা কমতে থাকে। সে সময় আমরা তাদের কাজ দিতে পারতাম।

শাকিল বলেন, নেপালে ডেডবডি ম্যানেজ করার বিষয়টি দেখেছি, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক কিছু শিখেছি। এসব দেশে গিয়ে প্রেজেন্ট করতে পারবো।

তিনি বলেন, যে ক্ষয়ক্ষতি নেপালে হয়েছে, সেটি ঠিক হতে অন্তত ১০ বছর লেগে যাবে। বেশিরভাগ বাড়ি-ঘরের ক্ষতি হয়েছে। যেগুলো বাইরে থেকে ঠিক মনে হচ্ছে, সেগুলোও ভেতরে ক্ষতিগ্রস্ত। ঢাকায় ৮০ শতকে গড়া বিল্ডিংগুলোর মতো এখানে অনেক বাড়ি। পর্যটন খাত নেপালের মূল, সেটির ক্ষতি হয়েছে সবচে’ বেশি।
 
শাকিল বলেন, যে ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে নেপালে যে ক্ষতি হয়েছে, এমন ভূমিকম্পে ঢাকার ক্ষতি অনেক বেশি হবে। ঢাকার এক লাখ ৭০ হাজার মানুষের অনেকেই মারা যাবে এমন ডিজেস্টারে।
 
এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘নেপালে খালি জায়গা আছে। ভূমিকম্পে সেখানে অবস্থান নেওয়া যায়। কিন্তু ঢাকায় তেমন জায়গা নেই। যতটুকু খালি আছে, সেখানে দাঁড়ালেও অন্য বিল্ডিং গায়ে এসে পড়বে। বিশেষ করে, পুরনো ঢাকার বিল্ডিংগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। তা নাহলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে।
 
তিনি বলেন, ঢাকায় যেসব বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়েছে, সেগুলো ভালোই। ’৭০ দশকে বাড়িগুলোর মতো নেপালে অনেক বাড়ি দেখেছি, সিমেন্টের পরিবর্তে বালি দিয়েছে, রডও নেই ভেতরে। তাইতো ভূমিকম্পে ঝুরঝুর করে পড়ে যায়।
 
শাকিল বলেন, নেপালের সৌভাগ্য যে, ২৫ এপ্রিল ছুটির দিন ছিল। সবাই ১০টার মধ্যে রান্না শেষ করে ফেলে এখানে। তাই চুলা ছিল নেভানো। ঢাকার মতো গ্যাসের লাইনও নয়, এখানে মানুষ সিলিন্ডার ব্যবহার করে। এদিকে লোডশেডিং ছিল সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা। তাই ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তা নাহলে বড় আগুন দেখা দিত।
 
তিনি বলেন, ঢাকায় গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের অনেক অবৈধ সংযোগ রয়েছে। তাই বড় ধরনের ভূমিকম্পে মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়বে কয়েক কিলোমিটার।
 
‘এছাড়া ওয়াসার পানি রিজার্ভ থাকে ৬৩ কোটি লিটার। ভূমিকম্পে সেগুলো ফেটে গেলে বন্যা হয়ে যাবে। সে পানিতে বিদ্যুতের তার পড়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে যাবে পানি এবং ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটবে’- আশঙ্কা মেজর শাকিলের।
 
আশঙ্কার পাশাপাশি সমাধানও বাতলে দেন শাকিল। তিনি বলেন ‘এজন্য ‘অটো-শাটডাউন সিস্টেম’ খুবই জরুরি। যাতে দুর্যোগকালে সব লাইন কেন্দ্রীয়ভাবে একসঙ্গে বন্ধ করা সম্ভব হয়। ’

তিনি বলেন, নেপালের তুলনায় ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি, তাই দুর্ঘটনায় একসঙ্গে বেশি মানুষ মারা যাবে। নেপালে সেভাবে কোন ফ্যাক্টরি নেই। ঢাকায় ফ্যাক্টরি ও গার্মেন্টস প্রচুর। ঢাকার বড় বিলবোর্ডগুলো পড়ে মানুষ মারা যাবে অনেক।
 
ভূমিকম্পে পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজনিয়তা তুলে ধরে শাকিল বলেন, এখানে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি এলাকায় কিছু মানুষ থাকে তারা স্বেচ্ছাসেবা দেয় অক্লান্ত। তাদেরকে আরও প্রশিক্ষিত করে রাখতে হবে। দেশে ৫২ শতাংশ নারী। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, তাদের মাধ্যমে পুরো পরিবার শিখতে পারবে।
 
‘ড্যামেজড অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। কোন কোন এলাকায় বেশি ক্ষতি দেখতে হবে। এয়ারক্রাফটে সেটি দেখা যায়। সেগুলোতে আগে লোক পাঠাতে হবে। তা নাহলে দেখা যাবে, যেখানে বেশি ক্ষতি সেখানেই সহযোগিতা গেল পরে’- বলেন তিনি।
 
শাকিল বলেন, দুর্যোগ মুহূর্তে কার কাছ থেকে সহযোগিতা নেব আর কার কাছ থেকে নেব না, সেটি এখনই ঠিক করতে হবে। বিমানবন্দরে ও দেশের এন্ট্রি পয়েন্টে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স আরও কার্যকর করতে হবে। তা নাহলে নেপালের মতোই সমস্যা হবে, হয়তো আরও বেশি হবে। সার্ক টিম আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে বাইরের দেশগুলোর সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।
 
তিনি বলেন, নেপালে স্বেচ্ছাসেবীদের ডেজিগনেটেড টিম নেই। তাই স্বেচ্ছাসেবীদের অর্গানাইজ করতেই ২ দিন সময় নষ্ট হয়েছে তাদের। এতে ক্ষতি বেড়েছে। আমাদের সতর্কতা প্রোগ্রাম বাড়াতে হবে। সরকারের যে কয়টি পোশাকধারী বাহিনী রয়েছে, প্রত্যেকের ট্রেনিং কারিকুলামে দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়টি রাখতে হবে। আগে থেকেই ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যে কোন দুর্যোগে অন্তত ৭ দিন টিকে থাকার প্রশিক্ষণ দিতে হবে প্রতিটি মানুষকে। স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচিতে এ সম্পর্কিত পাঠ রাখতে হবে। সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসকে আরও শক্তিশালী করেত হবে।

শাকিল বলেন, উদ্ধার অভিযান একটি বিশেষ ধরনের কাজ। এতে বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি লাগে। ইকুইপমেন্টের অভাবে প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বাড়ে। তাই সেসব পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখতে হবে।
 
পূর্বপ্রস্তুতির পরামর্শের সঙ্গে তিনি দুর্যোগ-পরবর্তী কিছু বিষয়েও মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন।  
 
শাকিল বলেন, ভিকটিমদের জন্য সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট খুবই জরুরি। আমি উদ্ধারকাজে দেখেছি- অনেকেই ট্রমায় ভোগেন। মানসিক ভারসাম্য হারান, এমনকি পরে আত্মহত্যাও করেছেন কেউ।
 
‘এখন নেপালের বাতাসে নানা জীবাণু রয়েছে। আমাদের দেশেও তাই এমন পরিস্থিতিতে মাস্ক, ডাইজেস্টার পরবর্তী সেবায় নার্স ও সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট জরুরি’- বলেন তিনি।
 
শাকিল বলেন, দুর্যোগে আমাদের প্রস্তুতি আরও বেশি রাখতে হবে। তখন তাঁবু হবে, সেটিতেও সমস্যা রয়েছে। মুসলিম দেশ, ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক তাঁবুতে তারা থাকবে না। এছাড়া মেয়েদের জন্য আলাদা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা ও স্যানিটেশন সামগ্রী রাখতে হবে। কারণ, তারা মুখ ফুটে নিজেদের সমস্যা ও চাহিদার কথা বলবে না। কাপড়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
 
অবশ্য বাংলাদেশের কিছু সুবিধার কথাও বলেন শাকিল।

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা সহযোগিতা করেন। তাদের প্রত্যেকের নম্বর ও লিস্ট রয়েছে আমাদের কাছে। নেপালে সেটি এখনো হয়নি। আমাদের দেশে কম্যুনিটি ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারে, এখানে সেটি তেমনভাবে দেখিনি। কারণ হয়তো তারা এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৫
এসকেএস/জেডএম

** নিরলস চেষ্টা হাসপাতালে
** ঘর বানাই দৌ, গোরি খানে দৌ
** জীবন এখানে এমন!
** বিধ্বস্ত নেপালে বাংলাদেশি সংবাদকর্মীরা
** শোকের ১৩ দিন, তবু জীবনের জয়গান
** নিস্তব্ধ পশুপতি, ভিড় কেবল চিতাঘাটে
** আড়ালেই ঝুরঝুরে নিম্বু-ভূতুড়ে ধর্মস্থালী
** দরবার স্কয়ার এখন তাবুর স্কয়ার
** বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই নাকে লাশের গন্ধ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।