ঢাকা: ১৯৫৩ সালে যুদ্ধের অবসান ঘটলেও কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটেনি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সে সময় শান্তিচুক্তিতে না গিয়ে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনই উত্তেজনা রয়ে যাওয়ার মূল কারণ।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার সূচনা ঘটে সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায়। এতে দুই দক্ষিণ কোরীয় সেনার মৃত্যু হয়। সিউল এ ঘটনার জন্য পিয়ংইয়ংকে দায়ী করে সীমান্তে লাউডস্পিকারে উত্তর কোরিয়া বিরোধী ‘প্রচারণা’ শুরু করে। দক্ষিণ কোরিয়ার এ ধরনের পদক্ষেপে উত্তেজিত হয়ে পড়ে পিয়ংইয়ং। সিউলকে ‘আগুনের সাগরে’ পরিণত করারও হুমকি দেয় উত্তর কোরিয়া। এতেও কোনো লাভ না হলে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে গোলাবর্ষণ করে পিয়ংইয়ংয়ের সেনারা। সেই সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) ‘প্রচারণা’ বন্ধ করতে সিউলকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেধে দেয় পিয়ংইয়ং। শনিবার (২২ আগস্ট) স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা) শেষ হতে চলেছে এ ‘ডেডলাইন’।
সম্মুখ যুদ্ধেই কি সমাধান?
কেউ কেউ বলছেন, ডেডলাইন শেষ হওয়া মাত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে দুই কোরিয়া। বৃহস্পতিবার হামলার পর সেদিন রাতেই কেন্দ্রীয় সেনা কমিশনের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় পিয়ংইয়ংয়ে। এ কমিশনের সভাপতি উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-উন।
বৈঠকে তিনি সেনাবাহিনীকে শুক্রবার (২১ আগস্ট) স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা থেকে ‘যুদ্ধকালীন অবস্থা’য় প্রবেশের নির্দেশ দেন। দেশকে ‘যুদ্ধকালীন রাষ্ট্র’ ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, অতর্কিত হামলার জন্য সেনাবাহিনীকে সার্বিক প্রস্তুত সম্পন্ন করতে হবে এই সময়ের মধ্যেই।
উত্তর কোরিয়ার অবস্থানের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থা বিচার করলেও কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের দামামা আরও জোরালোভাবে শোনা যাবে। পিয়ংইয়ংকে ‘সমুচিত’ জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটি।
শুক্রবার (২১ আগস্ট) দক্ষিণ কোরীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হ্যান মিনকু বলেছেন, এবার আমরা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উত্তর কোরিয়াকে তার প্রাপ্য জবাব দেব।
একই দিন পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তরক্ষার দায়িত্বে থাকা সেনা ইউনিটের সদর দফতর পরিদর্শন করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট পার্ক জিউন-হাই। এ সময় তিনি উত্তর কোরিয়ার কোনো অন্যায় সহ্য করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন।
অনেকেই বলছেন, উত্তর কোরিয়ার বর্তমান শাসক কিম জং-উন অপেক্ষাকৃত তরুণ হওয়ায় ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকায় এই উপদ্বীপে যুদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিম জং-উনের ব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিপজ্জনক কূটকৌশল অবলম্বন করে উৎরে যাওয়ায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সাং ও তার ছেলে কিম জং-ইল। কিন্তু সে তুলনায় কিম জং-ইলের ছেলে ও বর্তমান শাসক কিম জং-উন যথেষ্ট অসহনশীল। সীমান্তে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে কিংবা উত্তেজনা সৃষ্টির ব্যাপারে সিউল উস্কানি দিতে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল প্রয়োগে বাবা বা দাদার তুলনায় যথেষ্ট কাঁচা তিনি। তার প্রমাণ দিতেই হয়তো এবার শেল ছুড়ে বসেছেন তিনি।
অপরদিকে, দক্ষিণ কোরিয়াও এবার যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে। কারণ পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পেছনে সমালোচকরা অবশ্য অন্য কারণ দেখছেন। দক্ষিণ চীন সাগর ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চলছে। চীনকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল হিসেবে সিউলকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার ওপর কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রকেও পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছে পিয়ংইয়ং। এই সুযোগে উত্তর কোরিয়াকেও এক হাত নেওয়ার পরিকল্পনা করে থাকতে পারে দেশটি।
তবে অনেকে বলছেন, হুমকি আর হুঁশিয়ারিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে দুই কোরিয়ার উত্তেজনা। কোনো সম্মুখ যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। এর পক্ষেও শক্ত যুক্তি রয়েছে।
২০১০ সালেও একবার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্তে। সেবারও লাউডস্পিকারে প্রচারণাকে ঘিরেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ। সিউল প্রচারণার সব ব্যবস্থা করেও নীরব থাকে। ফলে সতর্কতার মধ্যেই দিন কাটতে থাকে দুই কোরিয়ার সেনাদের। যদিও অনেকে বলছেন, এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। তবু কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না অনেক বিশ্লেষক।
তাদের মতে, উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-উনই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসবেন। কারণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পিয়ংইয়ং পর্যন্ত সংঘাত চলে আসবে। অসন্তোষ দেখা দিতে পারে দেশের জনগণের মধ্যে। সেই সঙ্গে কোরীয় বা মার্কিন সেনাদের প্রবেশের ঝুঁকি তো রয়েছেই। সেক্ষেত্রে যুদ্ধে যদি তিনি পরাজিত হন, তাহলে উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবারের শাসনের অবসান ঘটবে।
ঠিক একই কারণে দক্ষিণ কোরিয়াও সামনে বাড়বে না। যুক্তরাষ্ট্র এখন সমর্থন দিলেও সম্মুখ যুদ্ধে নীরবতা অবলম্বনের সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া এশিয়ায় অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীন থাকবে কূটনৈতিকভাবে সিউলের বিপক্ষে। তার ওপর উত্তরের সেনারা একবার যদি সিউল পর্যন্ত চলে যায়, তাহলে বিপন্ন হবে দেশটির প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের জীবন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই কোরিয়ার মিত্ররা কখনোই সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা রাখবে না। কোরীয় উপদ্বীপে সংঘাত শুরু হলে তাদের নীরব থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তা না হলে বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি কিম জং-উন ও পার্ক জিউন-হাই ভালো করেই বোঝেন।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৫
আরএইচ/আরআই
** সীমান্তে মুখোমুখি দুই কোরিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তারা
** উ. কোরিয়াকে দ. কোরিয়ার পাল্টা হুমকি
** সেনাবাহিনীকে যুদ্ধপ্রস্তুতির নির্দেশ কিম জং-উনের
** সীমান্তে শেল হামলা চালিয়েছে উ. কোরিয়া
** সিউলকে ‘আগুনের সাগরে’ পরিণত করার হুমকি উ. কোরিয়ার