ঢাকা: সপ্তাহান্ত কাটিয়ে প্রথম কর্মদিবস সোমবারে চীনের সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স হঠাৎ করেই পড়ে যায় সাড়ে আট শতাংশ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতে বিনিয়োগকারীদের সাড়ে সাত লাখ কোটি রুপি গায়েব হয়ে যায়।
বলা যায় সূচকের লাগামহীন পতনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টালমাটাল হয়ে ওঠে সারা বিশ্বের শেয়ারবাজার।
প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ এই অস্থিরতার মূলে কী? কেন এই সূচকের পতন? অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা এখন ব্যস্ত তারই উত্তর খুঁজতে।
সঙ্কটের উৎপত্তি চীনে। চীনের শেয়ারবাজারে অস্থিরতার পদধ্বনি পাওয়া যায় গত সপ্তাহেই। তবে বিষয়টি তেল ব্যবসায়ী, চীনা আমলা ও হেজ ফান্ড ম্যানেজারদের মাথা ব্যথার বিষয় বলে একে পাত্তা দিতে চায়নি অনেকেই।
এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ সোমবার সাড়ে আট শতাংশ পড়ে যায় সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্সের সূচক। যার ধাক্কায় কেঁপে ওঠে বিশ্বের প্রায় সবগুলো বাজার।
সোমবার এক ভারতেই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিনিয়োগকারীদের পকেট থেকে লোপাট হয়ে যায় সাড়ে সাত লাখ কোটি রুপি। সেনসেক্স সূচকের পতন ঘটে ৬.২২ শতাংশ। বাঁচতে পারেনি মার্কিন মুলুকও। সেখানকার ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’ ইনডেক্স সোমবার সকালে নেমে যায় আড়াই শতাংশ।
কেন এই আকস্মিক পতন?
পুরো বিষয়টিই আসলে বৈশ্বিক পটভূমির একটি গল্প। যার শুরু ব্যস্ত সাংহাই নগরীর অলিগলিতে। মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকার তেলের খনি থেকে এই গল্পের ডালপালা বিস্তৃত ওয়াশিংটনের ফেডারেল রিজার্ভ (কেন্দ্রীয় আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা) ভবনের বারান্দা পর্যন্ত।
চীন দিয়েই শুরু করা যাক। ইদানীং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়ে উঠেছে চীনের বিপুল সংখ্যক উঠতি মধ্যবিত্তের এক নতুন খেলা। বেশ কয়েক বছর ধরেই চীনের অর্থ বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে এই উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনিয়োগে। পাশাপাশি ঝটিকা লাভের আশায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের চীনের শেয়ারবাজারে বিপুল পরিমাণ ‘হট মানি’র আমদানি সেই চাঙ্গাভাবে যোগায় নতুন হাওয়া। কম সময়ে অধিক মুনাফার আশায় শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগকেই লাভজনক পন্থা হিসেবে ধরে নেন চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কিন্তু গত কয়েক মাস আগে থেকেই সেই প্রবণতায় মন্দাভাব দেখা দেয়। একই সময়ে শ্লথ হয়ে পড়ে চীনের অর্থনীতির গতি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফটকা বাজারিরা চীনের শেয়ারবাজার থেকে লাভসহ তুলে নিতে থাকে তাদের বিনিয়োগ করা ‘হটমানি’।
এ পরিস্থিতির গুরুত্ব অবশ্য আগেই উপলব্ধি করতে পারে চীনা কর্তৃপক্ষ। পুরো গ্রীষ্ম জুড়েই বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ছিলো সরকারি প্রচেষ্টা। কিন্তু বেইজিংয়ের ব্যাপক কসরত সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি পতন। গত জুন থেকে এ পর্যন্ত সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স পড়ে গেছে ৩৮ শতাংশ।
চীনের অর্থনীতির গতি শ্লথ হওয়ার পেছনে অবশ্য বিশ্লেষকরা দায়ী করছেন বেইজিংয়ের বর্তমান সরকারের বেশ কিছু অর্থনৈতিক নীতিকে। এতদিনকার অনুসরিত বেশি বিনিয়োগ ও বেশি রফতানির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল এবং টেকসই করার নীতি নিয়েছে বেইজিং। এই পা পেছলানোর পেছনে চীন সরকারের সেই নীতিকেও দায়ী মনে করছেন অনেকেই।
চীন থেকে শুরু হলেও এই সঙ্কটের আকার ও ব্যাপ্তি এখন চীনের প্রাচীরের থেকেও বড়। তবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে একই সঙ্গে মাতাল হাওয়া বওয়ার জন্য শুধু চীনের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে সামনে আনা হলে সে ব্যাখ্যা হবে অসম্পূর্ণ।
এর পেছনে রয়েছে আরও অন্তর্নিহিত কিছু কারণ। এর ফলেই চীনা টাইফুনের মাতাল হাওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতির সমুদ্রে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় ঢেউয়ের।
গত কয়েক মাস ধরেই নিজেদের শেয়ার বাজারের ধস ঠেকানোর জন্য হস্তক্ষেপ করছিলো চীনা সরকার। কিন্তু তারপরও অর্থনীতির সহজ অবতরণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় বেইজিং। এই বিষয়টিই ভীতির সৃষ্টি করে সারা বিশ্বের শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
‘যেখানে চীনের প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের সব প্রচেষ্টা বাজারের ধস ঠেকাতে ব্যর্থ, তখন অন্যান্য বাজারের ভবিষ্যত কী?’ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে তাড়াহুড়ো করে হাতে থাকা শেয়ার ছেড়ে দিতে শুরু করেন তারা। অস্থিরতার এই ধাক্কা নিমিষে প্রবাহিত হয় মালয়েশিয়া থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সব উদীয়মান অর্থনীতির বাজারে।
তবে এই ধসের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু নীতিকেও দায়ী করা হচ্ছে।
সোমবারের এই ঘটনাকে তৃতীয় টেপার টেনট্রাম (ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের প্রনীত নীতির কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা)হিসেবে বিবেচনা করছে কোনো কোনো মহল।
প্রথম ‘টেপার টেনট্রাম’ হয়েছিলো ২০১৩ সালের জুন মাসে। ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারা বিশ্বের অর্থবাজারগুলো এক সাথে অস্থির হয়ে পড়েছিলো। সত্যিই সত্যিই মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে অর্থ প্রবাহ বন্ধ করতে যাচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় সৃষ্টি হয় এই অস্থিরতা।
এর আগে ২০০৬ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর সময় থেকেই বাজারের স্বাস্থ্য ধরে রাখতে নিয়মিতভাবে সেখানে অর্থের প্রবাহ বজায় রাখতো ফেডারেল রিজার্ভ।
একই রকমের দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে। যখন বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ‘ফেডারেল রিজার্ভ ২০১৫ সালেই সুদের হার বাড়াতে যাচ্ছে’।
এরই প্রতিক্রিয়ায় বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা মার্কিন শেয়ার বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে উচ্চ লাভের আশায় দ্রুতবর্ধনশীল উদীয়মান বাজারগুলোতে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে এসব দেশের অর্থবাজারে ঢোকে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ। শেয়ারের দাম বাড়ে হু হু করে।
কিন্তু যখন এই প্রবাহ থেমে যায় এবং দ্রুত বিনিয়োগকৃত এসব অর্থ অর্থনীতির ভাষায় যাকে অভিহিত করা হয় ‘হট মানি’, বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়, তখন বেড়ে যায় সুদের হার। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। সঙ্কটে পড়ে সেসব দেশের অর্থনীতি।
এছাড়া তেলের দামের অব্যাহত পতনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই সঙ্কটের পিছনে।
গত জুনেও তেলের দাম ছিলো ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলার। অথচ এখন তা নেমে এসেছে ৪০ ডলারে। বিষয়টি পশ্চিমা তেলের ভোক্তাদের জন্য সুখবর হলেও অর্থ বাজারগুলোতে সৃষ্টি করে আশঙ্কার।
গত বছরের শেষের দিকে যখন তেলের দাম পড়া শুরু করে, তখন সবাই ভেবেছিলো বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য উৎপাদকরা তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেবেন। কিন্তু দেখা গেলো ইরান, রাশিয়া ও ভেনেজুয়েলাকে জব্দ করতে দাম কমে যাওয়া সত্ত্বেও মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন বজায় রেখেছে, তাদের সাথে তাল মেলাচ্ছে সৌদি আরব সহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো।
অপরদিকে এসব তেলের মূল ভোক্তা চীনসহ এবং অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় একই সঙ্গে চাহিদা যায় কমে। ফলে বাজারে উচ্চ সরবরাহ এবং দুর্বল চাহিদা ত্বরান্বিত করে তেলের মূল্য পতন।
এতে শুধু জ্বালানি রফতানির ওপর নির্ভরশীল দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় যখন একই সময় মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ তাদের সুদের হার বাড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
এ সিদ্ধান্তের পেছনে কেন্দ্রীয় রিজার্ভের কর্মকর্তাদের যুক্তি হলো, মার্কিন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সঠিক পথেই আছে। তাই সুদের হার বাড়ানোর এটাই উপযুক্ত সময়।
আসলে মার্কিন অর্থনীতির সঙ্কট কাটাতে গত সাত বছর ধরেই সেখানে সুদের হার বজায় ছিলো শূন্য শতাংশের কাছাকাছি।
জানা গেছে, আগামী ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বরের নীতি নির্ধারণী বৈঠকেই সুদের হার বাড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে ফেডারেল রিজার্ভ।
সমালোচকরা অবশ্য ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের সুদের হার বাড়ানোর এই তৎপরতার সমালোচনা করেছে। জবাবে ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা সিদ্ধান্ত নেয় অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য সূচক যেমন মুদ্রাস্ফীতির হার ও বেকারত্বের হার পর্যালোচনা করে। তাদের মতে এখন পর্যন্ত মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির হার এবং বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে যদি আসন্ন ওই বৈঠকের সময় পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য এই অর্থনৈতিক সূচকগুলো স্থির থাকে, সেক্ষেত্রে বাজারের সূচক অস্থির হয়ে পড়লেও তাদের পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হবে না।
তবে বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা সেপ্টেম্বরে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাজারের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে বিবেচনা করবে ফেডারেল রিজার্ভ। পাশাপাশি তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, শেয়ারবাজারের এই অস্থিরতা মার্কিন প্রবৃদ্ধিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সব মিলিয়ে গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে এবারের অর্থনৈতিক সঙ্কটের গতি প্রকৃতি একটু জটিল।
অনেকগুলো বৈশ্বিক ও কূটনৈতিক সমীকরণে আটকে আছে এই সঙ্কট উত্তরণের অঙ্ক। শুধু মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ বা চীনা সরকারের প্রচেষ্টাই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫
আরআই/এমএমকে