ঢাকা: স্বভাবসুলভ হাসিতে সবসময় তার মুখ উদ্ভাসিত। যখন হেসে ওঠেন, তখন এমনভাবে নড়ে ওঠেন, যেন এক হাতে তিনি গাড়ির গিয়ার পরিবর্তন করছেন আর আরেক হাত কাল্পনিক হুইলে।
গত দুই বছর ধরে নাদিয়া পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলে হেবরন শহরে ট্যাক্সি চালান তিনি। ফুলের ছাপ দেওয়া ফিকে লাল স্কার্ফ ও দীর্ঘ কালো পোশাক পরে ব্যস্ত হেবরনের সড়কে তিনিও পুরুষ চালকদের সারিতে দাঁড়ান যাত্রীর খোঁজে।
কিশোর বয়সেই গাড়ি চালনায় নাদিয়ার হাতে খড়ি। ভাইয়েরা যখন গাড়ি চালাতেন কিংবা এর যন্ত্রাংশ ঠিক করতেন, তখন শুধু দর্শকের ভূমিকায় থাকতেন তিনি। তবে দেখেই ক্ষান্ত থাকতেন না তিনি। দর্শকের চোখে মনে মনে ঠিকই পড়ে নিতেন খুঁটিনাটি।
নাদিয়া বলেন, আমি এখন নিজেই আমার গাড়ির খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানি। ভাইদের কাজের সময় আমি শুধু দেখতাম আর দেখতাম। আর এখন আমি গাড়ি সম্পর্কে জানি, এমনকি আমি এখন গাড়ি থেকে কার্বুরেটরও আলাদা করতে পারি।
নাদিয়ার স্বামী স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তির অধ্যাপক। সমাজ তার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও স্বামী কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি।
নাদিয়ার মুখেই শোনা যাক তার ট্যাক্সিচালক হিসেবে যাত্রা শুরুর ঘটনা। তিনি বলেন, শুরুর দিকে প্রচুর সমালোচনা হতো আমাকে নিয়ে। ভাই যখন শুনলো, অন্য ট্যাক্সিচালকরা আমার ব্যাপারে কথা বলছে, সে রেগেমেগে বাড়ি এলো। তখনই আমাকে এ পেশা থেকে সরে দাড়ানোর নির্দেশ দিল।
ভাইয়ের এ ক্রোধান্বিত নির্দেশে কয়েক মাসের জন্য গাড়ি চালানো বন্ধ থাকে নাদিয়ার। কিন্তু স্বামী নাছোড়। তিনি তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করতে থাকেন। তারই অনুপ্রেরণায় ফের যাত্রা শুরু।
নাদিয়া এখন আর সেই কিশোরী নেই। তার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে মেয়ে স্বামীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জর্দানে বাস করছে। সেও তার মায়ের পথ অনুসরণ করেছে। গাড়ি চালানো শিখেছে, লাইসেন্সও করেছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে পেশায় নামা হয়নি এখনো।
এদিকে, যে কিশোরী নাদিয়া একদিন শখের বসে গাড়ির হুইল ধরেছিলেন, পরিবারের উৎসাহের কারণে আজ তিনি আরও বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর চিন্তা করছেন, যেখানে ট্যাক্সিচালক হিসেবে শুধু নারীদেরই নিয়োগ করা হবে। এবং এ ট্যাক্সিগুলোর যাত্রীও হবেন নারীরা।
স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে নাদিয়া বলেন, গাড়িগুলোর রং হবে নিয়ন সবুজ। নারী ট্যাক্সিচালকদের একটা ট্রেডমার্ক হবে এ রং।
যদি তার এ স্বপ্ন সত্যি হয়, তাহলে গ্রাহক ফোনেই ট্যাক্সির অর্ডার করতে পারবেন। নারীদের আর সড়কের ধারে অপেক্ষায় থাকতে হবে না, হাত নেড়ে নেড়ে ট্যাক্সি থামাতে হবে না।
এদিকে, নাদিয়ার সৃষ্ট উদাহরণে উৎসাহিত হয়ে আরও ছয় নারী এগিয়ে এসেছেন। লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারা এরই মধ্যে ট্যাক্সিচালক হিসেবে নিবন্ধন করেছেন। খুব বেশি দিন হয়তো আর নেই, যেদিন ফিলিস্তিনে একজন নাদিয়া নয়, এক হাতে গাড়ির গিয়ারস্ট্যান্ড, অপর হাতে হুইল ঘোরানোয় ব্যস্ত ততোধিক নাদিয়ার দেখা মিলবে।
রামাল্লার কাছে ফিলিস্তিনের বিরজেইতে অবস্থিত বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী অধিকার বিষয়ে অধ্যাপনা করেন নাহিদ আবু তাইমা। তার মতে নাদিয়া আহমেদ একজন ‘প্রবর্তক’ বা ‘পথ প্রদর্শক’। তিনি বলেন, নাদিয়াদের কারণেই একদিন ফিলিস্তিনি নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে।
তাইমা বলেন, নাদিয়ার মতো গাজায়ও একজন সংগ্রামী নারী আছেন। যতো দূর জানি, তিনি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ফিলিস্তিনি নারীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র, যিনি ওই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। এসব সহজ নয়। তবে এই সংগ্রামী নারীরাই নতুন যুগের সূচনাকারী। আগে যে পেশাগুলো ছিল কল্পনার অতীত, এখন এই সব সংগ্রামী নারীদের জন্যই তা সম্ভবে পরিণত হবে।
সমাজের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তাইমার মতামত, কোনো একদিন সমাজও এসব বুঝতে পারবে। তখন আর এমন বাধা থাকবে না।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৫
আরএইচ