ঢাকা: পাশাপাশি তিনটি কবর। একটা প্রিয়তমা স্ত্রীর।
বলা হচ্ছে, বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া তিন বছরের শিশু আয়নাল কুর্দির বাবা আব্দুল্লাহ কুর্দির কথা। এখন আর সিরিয়া ছেড়ে কোথাও যেতে চান না তিনি। কোবানে শহরের বাইরের পৃথিবীটা তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। স্ত্রী-সন্তানদের কবরে যেন আটকে গেছে জীবনের সবগুলো স্বপ্ন-সুখ।
কান্নাভেজা কণ্ঠে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আব্দুল্লাহ কুর্দির কানাডাপ্রবাসী বোন তিমা কুর্দি জানান, তার ভাই আর কোবানে থেকে নড়তে চাইছেন না। যা ঘটার ঘটবে, তবু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই কাটাতে চান তিনি।
চারপাশে ভ্রাতুষ্পুত্রদের ছবিতে ঘেরা তিমা বলেন, ভাইকে কানাডা আসার কথা বলতেই তিনি বললেন, এই পৃথিবীর কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমার যা ছিল, সব হারিয়ে গেছে। এখন আমি স্ত্রী-সন্তানদের কবরের পাশেই বাকি জীবন কাটাতে চাই। বেঁচে থাকা অবস্থায় তাদের সুন্দর জীবন দিতে পারিনি। তাদের কবরকেই এখন খাবার দেব, পানি দেব।
তিমা জানান, তিনি ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের শেষ বিদায় জানাতে কোবানেতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ কুর্দি তাকে মানা করে বলেছেন, তোমার এখানে আসা উচিত হবে না। এ জায়গা খুবই বিপজ্জনক।
২ সেপ্টেম্বর তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্র সৈকত থেকে উদ্ধার করা হয় আয়লানের মৃতদেহ। গত ১ সেপ্টেম্বর ১২ সিরীয় ইউরোপ পাড়ি জমাতে তুরস্কের বোদরাম উপদ্বীপ থেকে গ্রিসের এজিয়ান দ্বীপের উদ্দেশে দু’টো নৌকায় চেপে রওয়ানা হয়। এই ১২ জনের মধ্যে ছিল আইলানও। কিন্তু সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর বৈরী আবহাওয়া তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে দেয়নি। মায়ের কোল থেকে শিশু দু’টিকে যেন ছিনিয়ে নিল সমুদ্র। ভাসিয়ে নিল তুরস্কের সৈকতে। আর তার মা রেহান ভেসে গেলেন দূরের অন্য এক সৈকতে।
তিমা কুর্দির বর্ণনায় আরও স্পষ্ট ফুটে ওঠে বর্তমান সিরিয়ার পরিস্থিতি ও সংঘাতের কবল থেকে বাঁচতে চাওয়া মানুষগুলোর প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে রমরমা হয়ে ওঠা মানবপাচারের ব্যবসার চিত্র।
দুই দশক আগে তিমা কানাডা প্রবাসী হন। বর্তমানে তিনি দেশটির ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে কোকুইতলাম এলাকার বাসিন্দা। সিরিয়ায় সংকট মাথাচাড়া দেওয়ার পরপরই তিনি ভাইদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। প্রথমে তিনি তার বড়ভাই মোহাম্মদকে কানাডায় নিতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনপত্র অসম্পূর্ণ জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে কানাডা কর্তৃপক্ষ।
মোহাম্মদের ক্ষেত্রে এ ব্যর্থতাই আব্দুল্লাহকে তার পরিবার নিয়ে বিপজ্জনকভাবে সমুদ্রপাড়ি দিতে উদ্বুদ্ধ করে। তিমা বলেন, এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না আমাদের সামনে।
আত্মদহনে ভোগা তিমা নিজেকেই দায়ী করছেন ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের মৃত্যুর জন্য। তার মতে, ভাইয়ের কাছে কোনো অর্থ ছিল না। আমিই তাকে ৫ হাজার ডলার (৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা) পাঠাই পাচারকারীদের দিতে। ওই অর্থ না দিলে ওরা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ারও চেষ্টা করতো না, এভাবে অকালে ঝরেও যেতো না।
সিরিয়ার বর্তমান অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিমা বলেন, সিরিয়া এখন আতঙ্কের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) আমার ভাবীর এক আত্মীয়ের শিরশ্ছেদ করেছে। আমার ভাই সে হত্যাকাণ্ডের ছবি আমাকে ইমেইল করেছিল। রীতিমত ভয়ংকর এক দৃশ্য।
তিমা জানান, সাগরের বিপদের কথা আব্দুল্লাহ জানতেন। পাচারকারীরা তাদেরকে ভুয়া লাইফ-জ্যাকেট সরবরাহ করেছে, সেটাও তার জানা ছিল। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে একটু ভালো থাকতে হলে তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ইউরোপে পাড়ি জমাতে হবে। কোনো প্রকারে জার্মানি বা সুইডেন গিয়ে দাঁড়াতে পারলেই আর চিন্তা নেই এ ভাবনাই তাকে তাড়িত করে ঝুঁকি নিতে।
আব্দুল্লাহ কুর্দির এখন একটাই ভাষ্য, তার স্ত্রী-সন্তান অকালে ঝরে গিয়ে পৃথিবীবাসীকে যে বার্তা দিয়ে গেল, সে বার্তায় যেন বদলে যায় প্রচলিত মানবতার চিত্র।
বাংলাদেশ সময়: ০০১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৫
আরএইচ/আরআই
**আয়লানকে দেখে নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম
** সেই ছবিতে কাঁদছে বিশ্ব
** অন্যদের বাঁচাতে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই
** কোবানে সমাহিত আয়লান