ঢাকা: নজিরবিহীন অভিবাসী সংকটে পড়েছে বিশ্ব। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ আর দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী সংকট রীতিমত কাঁপিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের আসন।
বিশ্লেষকরা খুঁজছেন এ ‘মহাসংকট’র নেপথ্য কারণ, খুঁজছেন সম্ভাব্য সমাধানের পথও। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সীমান্তরক্ষা সংস্থা ফ্রন্টেক্স ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য বিশ্লেষণ করে এ সংকটের নেপথ্য কারণ ও সম্ভাব্য সমাধানের পথগুলো তুলে ধরছে বাংলানিউজ।
চলতি সপ্তাহে ইউএনএইচসিআর’র প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের আট মাসে অর্থাৎ আগস্ট পর্যন্ত ইউরোপে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৪শ’র বেশি অভিবাসী- শরণার্থী প্রবেশ করেছে। তুরস্ক রুট হয়ে গ্রিসে উঠেছে ২ লাখ ৪৫ হাজার শরণার্থী বা অভিবাসী। আর ইতালিতে উঠেছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ শরণার্থী বা অভিবাসী। এছাড়া, স্পেনে প্রায় দু’ হাজার এবং মাল্টায় প্রায় ১০০ অভিবাসী বা শরণার্থী উঠেছে। তবে, এ পথে নেমে প্রাণ হারিয়েছে অথবা নিখোঁজ হয়েছে ২ হাজার ৮শ’ মানুষ।
ইউরোপ অভিমুখে কেন এই শরণার্থী-অভিবাসীস্রোত?
জাতিসংঘ, ফ্রন্টেক্স এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একবাক্যে স্বীকার করেন, ইউরোপ অভিমুখে শরণার্থী-অভিবাসী স্রোত ঠেলে দিতে প্রধান ভূমিকা রাখছে সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র। আর এ স্রোত নামার প্রধান কারণ, সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোর যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান। দ্বিতীয় প্রধান কারণ, এশিয়া ও আফ্রিকান দেশগুলোর অতি-দারিদ্র্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিশ্চিত জীবিকার আকাঙ্ক্ষা বা জীবনমান উন্নয়নের অভিলাস। আর এ দু’টি কারণ ‘একসঙ্গে’ মিলে শরণার্থী-অভিবাসীস্রোতের কেবলই গতি ‘বাড়াচ্ছে’।
দু’টো কারণ ‘একসঙ্গে’ মেলার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইউএনএইচসিআর’র মুখপাত্র মেলিসা ফ্লেমিং বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশে, বিশেষত তুরস্ক-জর্ডান-লেবাননে শরণার্থী ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-সংঘাত বিধ্বস্ত দেশগুলোর মানুষ সরাসরি ইউরোপে যেতে চাইছে। কারণ, তারা মনে করে, সেখানকার ক্যাম্পগুলো তাদের ‘অস্থায়ী জীবন’ দেবে। কিন্তু তারা চান, নতুন করে ‘সুন্দর স্থায়ী জীবন’। সেক্ষেত্রে ইউরোপের বিকল্প হতে পারে না মধ্যপ্রাচ্য বা তৎসংলগ্ন অঞ্চল।
ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, শরণার্থী-অভিবাসীদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য জার্মানি, সুইডেন ও ব্রিটেন। এরপর আছে, ফ্রান্স-ইতালি-অস্ট্রিয়া-সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশ।
কোথা থেকে নামছে এই স্রোত?
ফ্রন্টেক্সের মতে, ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশকারীদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি আসছে সিরিয়া-আফগানিস্তান-ইরিত্রিয়া-ইরাক থেকে।
ইউএনএইচসিআর’র মতে, এ বছরের আট মাসে ইউরোপে যে শরণার্থী বা অভিবাসীরা প্রবেশ করেছে তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিক। আছে ১৪ শতাংশ আফগান, ৮ শতাংশ ইরিত্রিয়ান, ৪ শতাংশ নাইজেরিয়ান, ৩ শতাংশ ইরাকি, ২ শতাংশ সোমালিয়ান, ১ শতাংশ করে বাংলাদেশি, গাম্বিয়ান, ও সেনেগালিজ। আর ১৫ শতাংশ এশিয়া-আফ্রিকার কয়েকটি অনুন্নত দেশের নাগরিক। এই ১৫ শতাংশের মধ্যে আছে লিবিয়ান, ইথিওপিয়ান, মালিয়ান, উগান্ডানসহ সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের জাতিগুলোর লোকেরা।
কোন রুটে নামে এই স্রোত?
অভিবাসী-শরণার্থী আগুনে বেশি পুড়ছে তুরস্কের সীমান্তবর্তী ও ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী গ্রিস, ইতালি ও হাঙ্গেরি। ইউরোপে ওঠার ক্ষেত্রে সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের পছন্দের রুট তুরস্কের পূর্বাঞ্চল। এ দেশের পূর্বাঞ্চলের লেসবোস, চিওস, সামোস ও কোসের মতো দ্বীপগুলো থেকে নৌকায় চড়ে গ্রিসে যে মানুষগুলো প্রবেশ করছে, তারা আবার আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, মন্ট্রিনিগ্রো, রুমানিয়া ও শ্লোভেনিয়ার মতো বলকান দেশগুলো পাড়ি দিয়ে উঠছে হাঙ্গেরি। হাঙ্গেরি থেকে কেউ যাচ্ছে অস্ট্রিয়ায়, কেউ আবার অস্ট্রিয়া পাড়ি দিয়েই উঠছে জার্মানি-ফ্রান্সে। আর লিবিয়া-তিউনিশিয়া উপকূল থেকে মাল্টা হয়ে যারা ইতালিতে উঠছে, তাদের বেশিরভাগই দেশটিতে থেকে যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিচ্ছে, কেউ উঠছে ফ্রান্সে। আর মরক্কো উপকূল হয়ে জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে যারা স্পেনে উঠছে, তাদের বেশিরভাগও সেখানে থেকে যাচ্ছে, কেউ সুবিধা মতো চলে যাচ্ছে ফ্রান্স-পর্তুগাল।
জাতিসংঘের মতে, লিবিয়ায় মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সংঘাতের কারণে সে রুটটিকে এখন সব অঞ্চলের অভিবাসী-শরণার্থীরাই বিপজ্জনক মনে করে। আর এ কারণে সে রুটেরও চাপ পড়ছে তুরস্ক ও স্পেন সংশ্লিষ্ট রুটে।
কী করছে ইউরোপ?
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বিশেষজ্ঞ গ্রেহেম লুকাস মনে করেন, ‘বর্তমানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। যেসব বাধা পেরিয়ে শরণার্থীদের ইউরোপে যেতে হচ্ছে, তা অনেক ভয়ংকর এবং বেশিরভাগক্ষেত্রে প্রাণঘাতী। এটা স্বীকার করতে হবে যে, সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শরণার্থীদের বিপদসঙ্কুল পথে ইউরোপে পাঠাচ্ছে নিষ্ঠুর মানবপাচারকারী অপরাধী চক্র। ’
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলে সংঘাত চূড়ান্ত রূপ নিলেও গত এপ্রিলের আগ পর্যন্তও এমন সংকটের কথা ভাবেনি ইউরোপ। এপ্রিলেই ভূমধ্যসাগরে জাহাজাডুবিতে হাজারোধিক অভিবাসী-শরণার্থীর প্রাণহানির পর টনক নড়ে কর্তাদের। ভূমধ্যসাগরসহ তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অভিবাসী-শরণার্থী প্রবেশ ঠেকাতে তারা দফায় দফায় নীতি-নির্ধারণে বসেন। তারপর ভূমধ্যসাগরে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। মোতায়েন করেন নৌজাহাজও। মানবপাচারকারীদের ব্যবহৃত স্পটগুলো চিহ্নিত করে সেসব স্থানে কড়া নিরাপত্তা তৈরি করেন। কিন্তু জুন-জুলাইয়ে কোনো নিরাপত্তা-বেষ্টনীই আটকে রাখতে পারলো না শরণার্থী-অভিবাসীদের। এই পদক্ষেপে ভূমধ্যসাগরে দফায় দফায় অভিবাসী নৌকা আটক হতে থাকলো, নৌকা ডুবতে থাকলো-প্রাণহানি হতে থাকলো মানুষের। কড়া সমালোচনার মুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অভিবাসী-শরণার্থীদের প্রবেশে নিরাপত্তা শিথিল করে ইউরোপ কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এ সুযোগে আগস্টের শেষ দিকে যে স্রোত নামতে থাকলো ইউরোপ অভিমুখে, তাতে আর ‘সীমান্ত-ঠেকাও’ পদক্ষেপে না গিয়ে পারলো না অঞ্চলের দেশগুলো। কিন্তু এতে সেই আবার দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলো। সবশেষে অস্ট্রিয়ায় লরিতে ৭১ শরণার্থীর মরদেহ সন্ধান ও তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে শরণার্থী কুর্দি শিশু আইলানের মর্মান্তিক মৃত্যু পুরো বিশ্বকে নাড়া দেয়। এবার দুয়েকদিন কিছু কথা বলেও শরণার্থী-অভিবাসীদের আশ্রয়ে এগিয়ে আসে হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশগুলো। তাদের সহায়তা, পুনর্বাসন ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় সংকুলানে অর্থ বরাদ্দও ঘোষণা করতে শুরু করা হতে থাকে (ইতোমধ্যে ছয়শ’ কোটি ডলার ঘোষণা করেছে জার্মানি)। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলোর ঔদার্যে এতো বেশি অভিবাসী-শরণার্থীর ঢল নেমেছে যে, এখন আবার সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার মতো কথা ভাবতে হচ্ছে ইইউ কর্তৃপক্ষকে।
কী করতে পারে ইউরোপ?
গ্রেহেম লুকাসের মতে, ইউরোপকে এ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তারা শরণার্থী ও অভিবাসীদের বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্তে যেতে পারছে না বিধায়। সমস্যার প্রধান দিক হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রকৃত শরণার্থীদের সঙ্গে এশিয়ান, আফ্রিকান ও বলকান দেশগুলোর অনেকেও যোগ দিচ্ছে, যারা কেবল জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করছে। তাই ইউরোপকে একটি সমন্বিত অভিবাসন নীতিতে পৌঁছাতে হবে। তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে, তারা যুদ্ধ-সংঘাত বিধ্বস্ত দেশের উদ্বাস্তুদেরই গ্রহণ করবে, অভিবাসীদের নয়। আর আপাতত একটি দেশের ওপর পুরো শরণার্থী সংকট মোকাবেলার দায় চাপিয়ে না দিয়ে মানবতার স্বার্থেই সবগুলো দেশকে এ সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। উচিত সমস্যার মূল কারণ আন্তর্জাতিক দালাল চক্র নির্মূল করা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ-সংঘাত থামানো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৫
এইচএ/এমএমকে