ঢাকা, সোমবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

এল নিনোর প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে খাদ্যমূল্য

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
এল নিনোর প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে খাদ্যমূল্য

ঢাকা: এল নিনো এখন সারাবিশ্বের সবারই মাথাব্যথার বিষয়। এ মাথাব্যথা যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে।

চলতি সপ্তাহেই বিজ্ঞানীরা জানালেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। এল নিনো’র প্রভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়াও কোনো অংশে কম দুঃসংবাদ নয়, বলছেন বিজ্ঞানীরা।

 

সাধারণ কথায় সমুদ্রের উপরিভাগের পানির তাপমাত্রার একটি নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন হলো এল নিনো। স্প্যানিশ ‘এল নিনো’ শব্দের অর্থ ‘বালক’, যাকে যিশুর পুত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ পর্যাবৃত্ত উষ্ণ সামুদ্রিক জলস্রোতের এ পরিবর্তন সাধারণত উত্তর আমেরিকার ক্রিসমাসের সময়ই দেখা যায়। প্রতি ৩ থেকে ৮ বছরের মধ্যে এটি দেখা দেয়। ৯ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এটি।

 

সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, পূর্ব-কেন্দ্রীয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শান্ত সমুদ্রের পানির গড় তাপমাত্রা কমপক্ষে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (০.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটা একটি প্রাকৃতিক পর্যাবৃত্ত প্রক্রিয়া। সাধারণত এ প্রক্রিয়া পাঁচ মাস বা তার কম সময় ধরে চলতে পারে। কিন্তু যখন এটি পাঁচ মাসের অধিক সময় ধরে চলে, তখন একে এল নিনো অথবা লা নিনো নামে অভিহিত করা হয়। স্প্যানিশ ‘লা নিনো’ শব্দের অর্থ ‘বালিকা’। তাপমাত্রা হ্রাসের ঘটনাই লা নিনো নামে পরিচিত।

এল নিনো’র সাধারণ লক্ষণগুলো হলো- ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার উপরিভাগের পানির চাপের পরিবর্তন; তাহিতি ও বাকি মধ্য-পূর্ব শান্ত সমুদ্রের বায়ুচাপের হ্রাস; বিষুবরেখা বরাবর প্রবাহমান বায়ু উত্তর সমুদ্রে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়া বা পূর্বে চলতে থাকা; পেরুতে গরম বাতাসের প্রবাহ ও উত্তর পেরুভিয়ান মরুভূমিতে বৃষ্টিপাত; দক্ষিণ ও ভারতীয় সমুদ্র থেকে উত্তর সমুদ্রে উষ্ণ পানির বিস্তার; দক্ষিণ সমুদ্র ও সমুদ্রবর্তী অঞ্চলে অনাবৃষ্টি আর সাধারণত শুষ্ক উত্তর শান্ত সমুদ্র ও সমুদ্রবর্তী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত।

সম্প্রতি জাতিসংঘ জানিয়েছে, এল নিনো’র প্রভাবে ইথিওপিয়ায় এক কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রবল ক্ষরায় এই মানুষগুলো খাদ্যাভাবে রয়েছেন। চার লাখেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। জমির উর্বরতা শূণ্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে, খাদ্যাভাবে মারা পড়ছে পশু-পাখি। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। জাতিসংঘ বলছে, গত অর্ধ শতকের মধ্যে এ ক্ষরা সবচেয়ে মারাত্মক।

পাপুয়া নিউগিনিতেও প্রায় একই অবস্থা। এল নিনোর প্রভাবে দেশটিকে ক্ষরা আর বাতাসের হিম প্রবাহ একসঙ্গে পাকড়াও করেছে। ফলে প্রবল খাদ্য সংকটে পড়েছে পাপুয়া নিউগিনির জনগণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, দেশটির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ এরই মধ্যে এল নিনো আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো এবারের এল নিনো’র শেষ দেখা যাবে। তবে তার আগেই মানুষকে প্রবল ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়া। বিশেষ করে, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ব্যাপক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে এটি। এফএও’র ফুড ইনডেক্স মতে, গত বছরের চেয়ে এ বছর বিশ্বে খাবারের মূল্য ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-

মাছ: কথায় আছে, সমুদ্র জোগান দেবে। কিন্তু পৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র এখন আর আগের মতো জোগান দিচ্ছে না। বেশিরভাগ মাছ গভীরে, অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে, যা মোটেই মৎসশিল্পের জন্য সুখকর নয়। বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পেরে মারা পড়ছে অনেক মাছই। বাকি মাছগুলোর বেশিরভাগই গভীরে চলে যাওয়ায় আগের মতো আর জেলের মুখে হাসি ফুটছে না। সেই সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম স্রোত থাকায় সমুদ্রের গভীরে মাছের বংশবিস্তারও ব্যহত হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাজারে। বেড়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক মাছের দাম।

ক্যালিফোর্নিয়া, আরিজোনা আর নেভাডায় ১৮টি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করে কিং’স সিফুড কোম্পানি। এর ক্রয় ব্যবস্থাপক মাইকেল কিং বলেছেন, সিফুড-এর দাম আর মান সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে এল নিনোয়।

আঁখ: এফএও’র সাম্প্রতিক খাদ্যমূল্য তালিকায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে চিনির দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে, আঁখের দাম। গত ১৮ মাসে এ দাম ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। এ মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কম উৎপাদন। আর কম উৎপাদনের প্রধানতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন এল নিনোকেই।

পামওয়েল: ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি বছর মালয়েশিয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিশ লাখ টন কম পামওয়েল উৎপাদন হবে। এরই মধ্যে এ পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। তারওপর এভাবে উৎপাদন কমে যাওয়া মূল্যবৃদ্ধিকে আরো ত্বরান্বিত করবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। আর এ উৎপাদন হ্রাসের মূল কারণ হিসেবে এল নিনোকেই দায়ী করা হচ্ছে।

এখানে উল্লেখ্য, চকলেট, সাবান, জৈব জ্বালানিসহ নানা পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার উপযোগী করতে পামওয়েল ব্যবহার হয়ে থাকে।

ফল ও সব্জি: বৈশ্বিক উষ্ণ‍ায়নের সূচনালগ্ন থেকেই ফল ও সব্জি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম ব্লুবেরি, আনারস, তরমুজ, ফুলকপি ও লেটুস।

২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ব্লুবেরি উৎপাদনকারী অন্যতম দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা তাদের রপ্তানি বিলম্ব করতে বাধ্য হয়। অধিক বৃষ্টিপাত ও শীতল তাপমাত্রা এ বিলম্বের জন্য দায়ী, যা এল নিনো’র সরাসরি প্রভাব বলে মত বিজ্ঞানীদের।

এল নিনো’র প্রভাবে উষ্ণ হয়ে উঠেছে থাইল্যান্ড আর কোস্টারিকা। ফলে এসব অঞ্চলে ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আনারস আর কলার চাষ। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্যান্য সব্জি চাষও। কৃষিবিদরা বলছেন, বৃষ্টির মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব অঞ্চলে ফল ও সব্জির চাষ স্বাভাবিক হবে না। অর্থাৎ ২০১৬ সালেও উৎপাদন ব্যহত হবে।

গরমে স্বস্তিদায়ক ফলগুলোর অন্যতম তরমুজ। কিন্তু এল নিনো’র প্রভাবে এ পণ্যের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গুয়াতেমালায় কিংবা কোস্টারিকায় এবার তরমুজ উৎপাদন করতে গিয়ে রীতিমত মাথায় হাত পড়েছে কৃষকের।

এল নিনো’র প্রভাবে ফুলকপির উৎপাদন এতোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, গত দু’বছরে বিশ্ববাজারে এর দাম তিনগুণ বেড়েছে। আর লেটুস পাতার দাম গত বছরের চেয়ে এ বছর বেড়েছে ৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মরণকালের সবচেয়ে মারাত্মক এল নিনো’র কবলে পড়া বিশ্বকে প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী, আর কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হবে এবারের এল নিনো’র প্রকোপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বিজ্ঞানীদের এ ধারণা সত্যি হয়, তবুও খাদ্যদ্রব্যের মূল্যে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে, তা স্বাভাবিক হতে লেগে যাবে কমপক্ষে দু’বছর সময়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।