অসলো: নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ভয়াবহ হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক যুবক কোনো চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত বলে প্রথামিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয় নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ইয়েন স্টোলটেনবার্গ ইঙ্গিতে বলেছেন হামলাকারী ওই বন্দুকধারী একটি বড় সংগঠনের সদস্য হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের হামলাকারী ওই যুবক এবং এর পেছনে যারা জড়িত তাদের প্রতি আমার বার্তা হলো, আপনারা আমাদের ধ্বংস করতে পারবেন না। আপনারা আমাদের গণতন্ত্রকে থামিয়ে দিতে পারবেন না। ’
তবে এ হামলায় কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ দায়ী কি না সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি প্রধানমন্ত্রী। গোয়েন্দারা এ হামলায় ইসলামী সংগঠনের চেয়ে চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠন জড়িত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিতে চাচ্ছেন না।
শুক্রবার বিকেলে অসলোতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণ এবং পরে ইউটোয়াতে যুব সম্মেলনে গুলি এই দুই ঘটনা আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টিকে লক্ষ্য করে বলেই মনে হচ্ছে। বিচারমন্ত্রী নুট স্টোরবারগেট বলেছেন, বন্দুকধারী নরোয়েজীয়। তবে এর বেশি কিছু তার সম্বন্ধে আমি জানি না। ’
এমন সমন্বিত হামলার কৌশল মূলত আল কায়েদার সন্ত্রাসীরা অবলম্বন করে থাকে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কৌশল বেশ কার্যকরী হওয়ায় অন্য সন্ত্রাসী গ্রুপ তা অনুকরণ করতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এক্সিকিউটিভ অ্যানালাইসিসের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আটক সন্দেভাজনকে নরওয়েজীয় বলে মনে হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে, হামলা কোনো ইসলামী গ্রুপ নয় বরং চরম ডানপন্থীদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। যদিও আফগানিস্তানে নরওয়ের সেনা পাঠানোর কারণে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর টার্গেট হতে পারে।
আটক যুবক নিজেকে জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করলেও পুলিশ বলছে তিনি খাঁটি জাতীয়তাবাদী নন। তার মধ্যে চরম ডানপন্থী ভাবধারাই অনেক প্রবল। নরওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে এমন চরমপন্থী ডানদের ব্যাপারে পুলিশ আগে থেকেই কিছুটা ভয়ে ছিল।
নরওয়ের দৈনিক আফটেন পোস্টেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি পশ্চিমে চরম অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান বর্ণবিদ্বেষ এবং মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব যে হারে বেড়েছে তাতে চরম ডানপন্থীদের সহিংস হয়ে উঠার ব্যাপারে ভয় আরও বেড়েছে।
নরওয়ের নিরাপত্তা পুলিশ জানিয়েছে, গত বছর থেকে দেশে চরম ডানপন্থীদের তৎপরতা কিছুটা বেড়েছে। এই তৎপরতা চলতি বছরে আরও বেশি মাত্রায় বিস্তার লাভ করছে।
তবে এ আন্দোলন অনেক দুর্বল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব এবং শক্তিশালী হয়ে উঠার মতো যথেষ্ট সাংগঠনিক দৃঢ়তা তাদের নেই।
নব্য নাৎসিদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারীদের তথ্য মোতাবেক, এর আগে নরওয়েতে ডানপন্থীরা একাধিক হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ঐতিহাসিকভাবে এ সম্প্রদায়টি খুবই ক্ষুদ্র।
বিখ্যাত গ্রন্থ মিলেনিয়াম ট্রিলজিরর লেখক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত সুইডিশ লেখক স্টিয়েগ লারসোনও এমন তথ্যই দিয়েছেন। ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি তিনি নব্য নাৎসিদের সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করলে বর্ণবাদ ও চরমপন্থা বিরোধী এক্সপো নামে একটি প্রকাশনা শুরু করেন।
এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, সেই সময় সুইডেন ছিল তথাকথিত সাদাদের ক্ষমতায়ন সঙ্গীত এবং বর্ণবাদী প্রপাগান্ডার সবচেয়ে বড় সুতিকাগার। এখানে সহিংস নব্য নাৎসিরা বেশ সংগঠিত এবং শক্তিশালী ছিল।
তিনি বলেন, ‘বিপরীতপক্ষে নরওয়ের নব্য নাৎসিরা সে রকম সংগঠিত নয় এবং এদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। সুইডেনে একটি ডানপন্থিদের একটি সম্মেলনে নরওয়ের একটি ছোট গ্রুপও অংশ নিয়েছিল।
এই সম্মেলনের প্রেরণা নিয়েই পরে নরওয়ের চরম ডানপন্থীরা অপরাধ চক্রের সঙ্গে একটা শক্ত যোগাযোগ স্থাপন করে। একই সঙ্গে তারা ইউরোপ, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের চক্রগুলোর সঙ্গেও আঁতাত করে। তবে মধ্য ৯০‘এর পর সুইডেনে ডানপন্থীরা অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
কিন্তু একই সময় সুইডেনের মূলধারার রাজনীতিতে ডানপন্থী ভাবধারার প্রভাব বাড়তে থাকে। একই মনোভাব নরওয়েতেও লক্ষ্য করা গেছে। এখানে রাজনীতিকরা জনসমক্ষেই গলা উঁচিয়ে ডানপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করছেন। বাইরের দেশ থেকে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ এবং মূল্যবোধের লোকেরা এসে নরওয়ের ঐহিত্য ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে ফেলছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তারা।
অসলো এবং ইউটোয়াতে হামলার পর এখন সব নরওয়েজীয়দের মধ্যে এমন একটি জটিল প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলে সামনে কোথা থেকে আরও ভয়াবহ হামলার হুমকি আসছে। সচেতন নাগরিকদের মধ্যে এমন উপলব্ধি জাগছে, চরমপন্থা কখনো জাতীয়তা, নৃতত্ত্ব বা ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১১