একেবারে অবহেলিত জনপদ বা তৃণমূল থেকে দু’জনকে তুলে এনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুই পদে আসীন করানোর এই মহিমা দেখানো দেশটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত’। রামনাথ-মোদি নাম উচ্চারণেই এখন সামনে আসে, এই বুঝি গণতন্ত্রের মহিমা।
২০১৪ সালে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদিও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশের সরকারপ্রধান। একজন চাওয়ালার ছেলেকে জনগণ বসিয়েছে দেশ পরিচালনার আসনে।
এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতে যাওয়া রামনাথও ভাবতে পারছেন না, তার মতো মাটির ঘরে বেড়ে ওঠা মানুষ ভারতের মতো দেশের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পেয়ে গেছে। তিনি হয়ে গেছেন এশিয়ার দ্বিতীয় প্রধান পরাশক্তি দেশের রাষ্ট্রপতি।
নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই দেশের জনগণের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়ে আসছেন। তৃণমূলের স্বপ্নবাজ তরুণদের অনুপ্রেরণা যোগাতে নিজেকে পরিচয় দিয়ে আসছেন ‘চাওয়ালার ছেলে’ হিসেবে।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর রামনাথও ঝরালেন তেমনই আবেগ। বললেন তার পরিবারের সংগ্রামের কথা। শৈশব থেকেই বৃষ্টি-পানি-কাদার সঙ্গে সংগ্রাম করে বড় হয়ে ওঠার কথা।
‘তখন আমরা মাটির ঘরে থাকতাম, এই ঘরকে আমরা বলতাম কুচ্চা। বৃষ্টি হলে সেই কুচ্চার চালা চুইয়ে পানি পড়তো, আর ভাই-বোনেরা মিলে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন বৃষ্টি থামে সে অপেক্ষায়। কখনো বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে কাদা মেখে চলতে হতো, স্কুলে যেতে হতো। ’
রামনাথের এই ক’টা বাক্যেই আঁচ করা যায়, কোন মফস্বল থেকে উঠে এসেছেন তিনি। কোন গাঁয়ের মাটির ঘ্রাণ লেগে আছে তার শরীরে।
এ যে আসলেই গণতন্ত্রের মহিমা সে কথা পুনরায় স্মরণ করতে ভুললেন না রামনাথ, ‘কখনো চিন্তাও করিনি আমি এই পদে নির্বাচিত হতে পারবো। চেয়েছি কেবল সমাজ ও দেশের সেবা করতে। দেশ আজ আমাকে এখানে এনে দিয়েছে, সেবার আরও বড় দায়িত্বে। এটা আমার জন্য অনেক আবেগঘন একটা মুহূর্ত। আমার মতো একজন ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া এ দেশের গণতন্ত্রের মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব। ’মাটির ঘর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে রামনাথ
রামনাথের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা তীরবর্তী কানপুরের পারাউখ গ্রামে। তার বাবা মাইকুলাল ছিলেন গ্রামের ভূমিহীন কোড়ি বা তাঁতী। মাইকুলাল ও তার স্ত্রীর ছিল পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা। এই বড় সংসার নিয়ে তারা থাকতেন গ্রামের এক কোণে একটি মাটির ঘরে। এই ঘর সংস্কারের অভাবে একসময় ধসে পড়ে। পরে তারা আবাস গড়েন একটি খড়ের কুঁড়েঘরে। কিন্তু রামনাথের পাঁচ বছর বয়সে সেই কুঁড়েঘরেও আগুন লেগে পুড়ে মারা যান মা।
এরপর মাইকুলাল একটি ছোট্ট দোকান নিয়ে বসেন সংসার চালাতে। জীবিকা নির্বাহের এই যুদ্ধে মাইকুলাল সন্তানদের শিক্ষার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করতে পারছিলেন না। এরমধ্যেই রামনাথ সংগ্রামকে নিয়তি হিসেবে নিয়ে পাঠে মনোযোগী হন।
গাঁয়ের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি ভর্তি হন কানপুরের আরেকটি মাধ্যমিক স্কুলে। ওই অঞ্চলের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া গ্রাম হিসেবে যোগাযোগ অবকাঠামোও ভালো ছিল না পারাউখের। তাই এই গ্রামে বাইসাইকেল পর্যন্ত ছিল না কারও। সেই গ্রাম থেকে ৬ কিলোমিটার দুর্গম-দীর্ঘ পথ হেঁটে গিয়ে কানপুরের ওই মাধ্যমিক স্কুলে ক্লাস করতেন রামনাথ। বছরের পর বছর সেই স্কুলে পাঠ শেষে রামনাথ কানপুর থেকেই নেন উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা। এরপর এই শহরেরই কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় অধীভূক্ত ডিএভি কলেজ থেকে অর্জন করেন বাণিজ্য ও আইনে স্নাতক ডিগ্রি।
উচ্চতর পড়াশোনার পর রামনাথ চলে আসেন নয়াদিল্লিতে। ১৬ বছর দিল্লি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এরমধ্যেই জড়ান বিজেপির দলিত মোর্চার রাজনীতিতে। দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রতিনিধির ভূমিকা আরও কার্যকর করার অভিপ্রায়ে ১৯৯৪ সালে তিনি বিজেপি প্রার্থী হিসেবে উত্তর প্রদেশ থেকে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় সদস্য মনোনীত হন। এরপর একই দল থেকে টানা দু’বার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট রামনাথকে বিহারের রাজ্যপাল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৯৮ সাল থেকেই বিজেপির দলিত মোর্চার নেতৃত্বে থাকলেও রামনাথ বিজেপির অনেক নেতাকর্মীর কাছেও ছিলেন অপরিচিত, তার প্রচারবিমুখ এবং নিভৃতচারিতার কারণে। এই অপরিচিতি, এই দীর্ঘ সংগ্রামী-লড়াকু মানুষটাই এখন উঠে যাচ্ছেন রাইসিনা হিলের ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে’।
চা বিক্রেতা থেকে সাধু, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির জন্ম ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মধ্য প্রদেশ রাজ্যের উজ্জৈন জেলার বড় নগরে। বাবা দামোদারদাস মূলচাঁদ মোদি ও মা হীরাবেন মোদি। কৈশোরে পড়াশোনার পাশাপাশি বড়নগর রেলস্টেশনে বাবাকে চা বিক্রি করতে সহায়তা করতেন মোদী। এই পৌরশহরেই একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন তিনি।
মোদির সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারে কৈশোরে তার বিয়ে ঠিক হয়। তের বছর বয়সে যশোদাবেন চিমনলাল নামে এক মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয় এবং আঠারো বছর বয়সে তাদের বিয়ে সম্পন্নও হয়। তবে, মোদি সাধু জীবন বেছে নেওয়ায় খুব অল্প সময়ে দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে।
দুই বছর সাধু জীবন শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে পুনরায় চা বিক্রির ব্যবসায় নেমে পড়েন মোদি। মাঝে গুজরাট রাজ্যে একটি সরকারি ক্যান্টিনের কর্মচারী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ১৯৭০ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস) প্রচারক হিসেবে যোগ দেন তিনি। এর মধ্যেই তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক এবং গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে আরএসএস নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া ও সংগঠনটির অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান মোদি। ১৯৮৫ সালে তাকে বিজেপিতে পাঠায় আরএসএস। গুজরাট বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে একসময় কেন্দ্রীয় বিজেপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মোদি। ২০০১ সাল থেকে টানা তিন দফায় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। চা বিক্রেতা থেকে সাধু হয়ে ২০১৪ মালের ২৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন সেই মোদি, যিনি এরইমধ্যে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছেন তার সমর্থকদের বিচারে।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৮ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
এইচএ/