সিরতে: লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হয়েছেন। বিরোধী এনটিসি বাহিনীর সঙ্গে ঘোরতর লড়াইয়ের এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার নিজ শহর সিরতের অদূরে পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত ও সদা সংঘাতমুখর একটি যুগের অবসান ঘটলো।
গাদ্দাফির মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর নেতারা আনন্দিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তবে হোয়াইট হাউস এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এদিকে লকারবি বিমান হামলায় নিহতদের পরিবার পরিজন গাদ্দাফির মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। ‘‘ভয়ানক খুনি তার পাওনা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে পেয়েছে’’--এই বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এরকমই একটি পরিবার।
আল জাজিরা টিভিসহ গোটা বিশ্বের টিভি চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যমগুলোর এটাই এখন সবচেয়ে বড় খবর। প্রতি মুহূর্তে গাদ্দাফি ও তার মৃত্যুকে ঘিরে, তার ৪২ বছর দীর্ঘ বিতর্কিত শাসনামলের ওপর সংবাদ ও অভিমত প্রচার করা হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে গাদ্দাফির গুলিবিদ্ধ লাশের ছবিও।
এ মুহুর্তে গাদ্দাফির মৃত্যুতে খোদ তার জন্মশহর সিরতেসহ লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে চলছে এনটিসি সেনা ও গাদ্দাফিবিরোধীদের আকাশ ফাটানো আনন্দ উল্লাস। এনটিসি সেনারা মুহুর্মুহু করতালিতে গান গেয়ে, নেচে লাফিয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা। সারা লিবিয়ার মানুষ এখন নেমে এসেছে রাস্তায়। বাদ নেই শিশু নারী ও বয়স্করাও।
গুলিতে নিহত গাদ্দাফির মরদেহ নিরাপত্তার কারণে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে আল জাজিরা টিভির খবরে জানানো হয়। তবে তার মরদেহ লিবিয়ার কোথাও নাকি লিবিয়ার বাইরে ন্যাটোবাহিনীর সেনা ছাউনিতে বা কোনো বিমানবাহী রণতরীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে জল্পনাও শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে একটি সংবাদ সংস্থা গাদ্দাফির লাশ মিসরাতা শহরের জনগণকে দেখানো হয়েছে বলে দাবি করলেও সে খবরের সত্যতা নিরপেক্ষ সূত্র থেকে নিশ্চিত করা হয়নি।
উল্লেখ্য, মাসকয় আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানতম শত্রু আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের সামরিক শহর অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিল বাহিনী এক নৈশ অভিযানে হত্যা করার পর তার লাশটি পাকিস্তানের বাইরে নিয়ে যায়। এরপর মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস স্টেনিসে করে সমুদ্রবক্ষে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তা।
গাদ্দাফির মরদেহ নিয়েও অনুরূপ কিছু করা হবে কিনা এরই মধ্যে এমন জল্পনা ডালপালা ছড়াচ্ছে।
গাদ্দাফির মৃত্যুতে যুক্তরাষ্টসহ পশ্চিমা দেশগুলো জানাচ্ছে সানন্দ প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র , ফ্রান্স , যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ন্যাটো মিত্র দেশগুলোর সামরিক ক্যাম্পেইনের জয় হওয়ায় পশ্চিমা নেতারা খুবই সন্তুষ্ট।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন জীবিত বা মৃত গাদ্দাফির জন্য পুরস্কার গোষণার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই নিহত হলেন গাদ্দাফি। এর মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কূটনীতিরই জয় হল।
তবে টিভিতে গাদ্দাফির গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া যে ছবিটি দেখানো হয়েছে তা রীতিমতো রক্তাক্ত ও স্নায়ুপীড়াদায়ক। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান হলো একটি ঘটনাবহুল, সদা সংঘাতময় যুগের। সেই সঙ্গে সূচনা ঘটলো হলো তেলসমৃদ্ধ লিবিয়া ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক অনিশ্চিত ভবিতব্যের।
এর আগে বৃহস্পতিবার এনটিসির একাধিক মুখপাত্র গাদ্দাফিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করার ও পরে তার মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলেন।
গাদ্দাফির গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত ও গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটি প্রথম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন এনটিসিরই কয়েকজন কমান্ডার। এদের একজন হচ্ছেন মাহামেদ লেইথ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘‘গাদ্দাফিকে সিরতে থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করা হয়েছে। তিনি গুরুতর আহত। তবে এখনও শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। ’’
প্রায় একই সময় গাদ্দাফির আটকের ব্যাপারে এনটিসির আরেক কর্মকর্তা আবদেল মাজিদ বলেছিলেন, ‘‘তিনি আটক হয়েছেন। তিনি দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ’’ পরে তিনি সাংবাদিকদের আরো জানান,‘‘ শুধু দুই পায়ে নয়, মাথায়ও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন গাদ্দাফি। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ’’
পরে এনটিসি কর্মকর্তা মোহামেদ লেইথ "গাদ্দাফি আর বেঁচে নেই’’ বলে দাবি করেন। লেইথের দাবির সাথে সুর মিলিয়ে এনটিসির অপর এক কমান্ডার মোহাম্মদ বেলহাজ আল জাজিরা টিভিকে গাদ্দাফির মারা যাওয়ার খবরটির সত্যতা নিশ্চিত করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই গাদ্দাফির মারা যাওয়ার খবরটির সচিত্র প্রমাণ উঠে আসতে থাকে আল জাজিরাসহ বিশ্বজুড়ে প্রচারিত বিভিন্ন টিভি ফুটেজে।
এর আগে আল জাজিরাকে উদ্ধৃত করে ভারতের এনডিটিভি বৃহস্পতিবার শেষ বিকেলে জানায়, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে এনটিসির সেনারা তার বাংকারে অতর্কিত হানা দেওয়ার পর গাদ্দাফি পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলে গাদ্দাফি এনটিসি সেনাদের উদ্দেশে ‘ডোন্ট শুট মি , ডোন্ট শুট’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ পর্যায়ে তিনি তাদের দিকে নিজের পিস্তলও তাক করেন। কিন্তু গাদ্দাফির কথায় কর্ণপাত না করে এনটিসি সেনারা তাকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি চালাতে থাকে। গুলিতে তার সারা শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এ সময় গাদ্দাফির পরনে ছিল খাকি সামরিক পোশাক ও মাথায় ঐতিহ্যবাহী পাগড়ি।
এর আগে গাদ্দাফির আহত হওয়ার অসমর্থিত প্রাথমিক খবরটি যখন গণমাধ্যমে আসা শুরু হয় তার কিছুক্ষণ পরপরই এনটিসির একাদশ ব্রিগেডের কমান্ডার আব্দুল হাকিম আল জলিল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় বৈরুতের ডেইলি স্টার পত্রিকাকে বলেছিলেন, তিনি গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ আবু বকর ইউনুস জবরের মৃতদেহও নিজের চোখে দেখেছেন।
তিনি তখন বলেন, "আমি নিজের চোখে ইউনুস জবরের লাশ দেখেছি। তিনি এ সময় প্রমাণ হিসেবে রয়টার্স ও বৈরুতের ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিনিধিকে জবরের রক্তাক্ত লাশের একটি ছবিও দেখান।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জন্মশহর সিরতের পতনের পর এনটিসির হাতে গাদ্দাফির আটক হওয়ার খবরটি প্রকাশ পায়। এরপর তার নিজের ও তার প্রধান সেনাপতির মৃত্যুর খবরটিও পাওয়া যায়।
পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে আনন্দিত প্রতিক্রিয়া:
পশ্চিমা নেতারা গাদ্দাফির মৃত্যুতে রীতিমতো উল্লসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা তার মৃত্যুকে দীর্ঘ ৪২ বছর দীর্ঘ এক স্বৈরশাসনের এক ভীতিকর একনায়কতন্ত্রের অবসান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তাদের মতে, ‘এ এক বিরল ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ’ ওয়াশিংটনে রিপাবলিকান দল মনোনীত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সিনেটর জন ম্যাক কেইন বলেন, ‘‘এটা লিবীয় বিপ্লবের প্রথম অধ্যায়ের সূচনা। লিবীয় জনগণ তাদের দেশকে মুক্ত করলো। ’’
এ মুহুর্তে আফগানিস্তান সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন বলেন,‘‘খবরটা যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে লিবিয়ার জন্য এটা এক মাহেন্দ্রক্ষণ। ’’
গাদ্দাফির এক সময়কার ঘনিষ্ট বন্ধু বলে পরিচিত ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকনি বলেন, ‘‘ এখন যুদ্ধ শেষ। সূচনা হয়েছে পৃথিবীর গৌরবময় এক মুহূর্তের। ’‘
ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকে বলা হয়, ‘‘একনায়কতন্ত্রের অবসান হয়েছে। ’’
ইইউ প্রেসিডেন্ট হারমান ফন রম্পুই ও ইউরোপিয়ান কমিশন সভাপতি হোসে মানুয়েল বারোসো যৌথভাবে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘লিবীয় জনগণের দুর্ভোগের অবসান হল আজ। ’’
বারাক ওবামার ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ ভোটের পাল্লা ভারী :
প্রথমে লাদেন তারপর আনোয়ার আওলাকি আর সবশেষে গোটা দুনিয়ার এক সময়ের ত্রাস বলে পরিচিত লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা--এই তিনটি সাফল্য ক্রম-পড়তির দিকে চলে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাবমূর্তিকে আবার চাঙ্গা করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন ওবামার জন্য গাদ্দাফির এই মৃত্যু বড় এক আশীর্বাদ বয়ে আনবে। বিশেষ করে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এটা ওবামার হাতে এনে দেবে অনেক তুরুপের তাস।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ ওয়েইন হোয়াইটের ভাষায়: ‘‘ওবামার জন্য এ এক বিরাট সাফল্য। এটা ভোটের দৌড়ে তার বিরোধীদের একপাশে ঠেলে তাকে এগিয়ে দেবে অনেক দূর। ’’
পড়ে গেছে অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম:
গাদ্দাফির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তেলের দাম পড়ে গেছে বলে জানাচ্ছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। বৃহস্পতিবার বিকেলেই তেলের দাম পড়ে যায়। তেল খাতের বড় বিনিয়োগকারীদের আশা, অচিরেই লিবিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল রপ্তানি শুরু হবে আর এক্ষেত্রে কেটে যাবে চলমান অনিশ্চয়তা।
উল্লেখ্য, লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতিদিন লিবিয়া থেকে ১৭ লাখ ব্যারেল খুবই উচ্চমানের অশোধিত তেল রপ্তানি হতো।
লিবিয়াতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পর গত আগস্টে গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১১