তবে রোববার (২১ এপ্রিল) কলম্বোর সানগ্রি-লা হোটেলে হামলা করতে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেননি হাসিম। নিজের নেতৃত্বে সৃষ্টি হওয়া বিস্ফোরণেই হাসিমের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ।
হামলার পরপরই এর নেতৃত্বে ছিলেন জাহরান হাসিম, তিনিই এর মূলহোতা- এমন তথ্য উঠে আসে কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে শুরু হয় ‘এই অবাধ্য ও কুলাঙ্গার হাসিম কে? কী তার পরিচয়? কেনো এ বর্বর হামলা?’- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। তাৎক্ষণিক বেরিয়েও এসেছে সব প্রশ্নের সহজ উত্তর।
শ্রীলঙ্কান সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলবর্তী শহর কত্তানকুড়িতে ছোট্ট একটি বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন হাসিম। সঙ্গে থাকতেন তার আরও চার ভাই-বোন। হাসিমের বাবা ছিলেন ফেরিওয়ালা; রাস্তায় রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। তবে ছিঁচকে চোর বলে তার বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিল।
সংসারের প্রতিকূল অবস্থায় বেড়ে উঠেছেন হাসিম। তবে ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী; স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো ছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে জামিয়াতুল ফালাহ আরবি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে চলে আসেন কলেজের সব শিক্ষকের নজরে।
শিক্ষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, হাসিম খুবই মেধাবী, তেমনি অনেক জেদি, আবার চরমপন্থী রকমের স্বভাবের। তিন বছরের মধ্যে কোরআন মুখস্ত করে ফেলেছিলেন হাসিম। আওতায় নিয়ে এসেছিলেন ইসলামি অনেক আইনও। ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল তার খুবই বেশি। এ আগ্রহ যতোই বাড়ছিল, ততোই অবাধ্য হয়ে উঠছিলেন। তখন শিক্ষকদের সঙ্গে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হতে থাকে। এমনকি একটা সময় শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণও ঠিকভাবে করতেন না।
জামিয়াতুল ফালাহ আরবি কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যক্ষ এসএম আলিয়ার জানিয়েছেন, প্রচলিত পড়ানোর পদ্ধতি হাসিমের পছন্দ ছিল না। কলেজে যেভাবে কোরআন ব্যাখ্যা করা হতো, হাসিম ছিলেন এর বিপরীত। তিনি এসব একেবারেই পছন্দ করতেন না। তার বিশ্বাস ছিল জিহাদি ইসলামে।
পরবর্তীতে তার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৫ সালে তাকে বহিষ্কার করে কলেজ। এরপর অসাধারণ মেধা দিয়ে আরেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (মসজিদ) চাকরি হয়ে যায় তার। তবে সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারেননি। একই কট্টর আচরণ শুরু হলে চাকরিটি হারাতে হয় তাকে।
দারুল আথার নামে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইমাম এমটিএম ফাওয়াজ জানিয়েছেন, কারও মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতেন না হাসিম। নিজে থেকেই সব করে ফেলতেন। একইসঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তার ছিল আপত্তি। উদারপন্থী সুফি সাধকদের বিরুদ্ধে ছিলেন হাসিম। সুফি মসজিদের দায়িত্বে থাকা সংগঠনের সচিব সাহলান খলিল রহমান জানিয়েছেন, ২০০৪ সালে কত্তানকুড়ির একটি সুফি মসজিদে গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৬ সালে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বেশ কিছু বাড়িতে। এমনকি তাদের এক নেতাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয় প্রকাশ্যে। আর এর সুযোগ নিয়েছিলেন হাসিম। তখন দেশের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে তার ব্যাপারে বলাও হয়েছিল।
আরও পড়ুন>> শ্রীলঙ্কায় নিহত সংখ্যা ১০৬ কমে ২৫৩
সংবাদমাধ্যম বলছে, হাসিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জিহাদি বক্তব্য দিতেন। তার পোস্ট করা বিভিন্ন ভিডিও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উসকানি সৃষ্টি করতো। এমনকি ভিডিওতে তিনি জিহাদের আহ্বানও জানিয়েছেন; নাশকতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। একটি ভিডিওতে হাসিম এমনই বলেছেন, একটা কিছু করবো, ধ্বংসাবশেষই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহকে যারা ‘অপমান’ করে, তাদের ধ্বংস করার ব্যবস্থা করবো।
এদিকে, হামলার দিনই সানগ্রি-লা হোটেলে নিজের বোমা বিস্ফোরণেই নিহত হন হাসিম- এমনটি জানিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। তবে সানগ্রি-লা হোটেলের হামলায় হাসিমের ভূমিকা কী ছিল, তা নিশ্চিত করেননি সিরিসেনা।
এছাড়া টুইটে দেশটির পুলিশ জানিয়েছে, হাসিম স্থানীয় বিদ্রোহীগোষ্ঠী ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের নেতা ছিলেন।
২১ এপ্রিল খিস্টানদের বড় ধর্মীয় উৎসব ইস্টার সানডে উদযাপনের সময় শ্রীলঙ্কায় তিনটি গির্জা ও চারটি হোটেলে ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলা হয়। এরপরই বাড়তে থাকে নিহত সংখ্যা। শেষপর্যন্ত ৩৫৯ এ গিয়ে ঠেকে। যা থেকে পরে গণনায় ভুল হয় বলে ১০৬ জন কমে ২৫৩ তে এসে দাঁড়ায়।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সিরিয়া ও মিশরের বিদেশিসহ অন্তত ৭৬ জনকে আটক করেছে দেশটির পুলিশ। এ হামলার পেছনে স্থানীয় বিদ্রোহীগোষ্ঠী ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত রয়েছে বলে জানিয়ে আসছে তারা।
তবে বর্বর হামলাটির দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। প্রমাণ হিসেবে হামলাকারীদের বেশ কয়েকটি ছবিও প্রকাশ করে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৯
টিএ