২৬ বছর বয়সী গৌরি শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতাকামী তামিল টাইগারদের যোদ্ধা ছিলেন, যারা রোশানের (২৯) মতো সিংহলিজদের শত্রু ভাবতেন।
তিনি বলেন, আমি আগে কখনো সিংহলিজ দেখিনি বা তাদের সঙ্গে কথা বলিনি।
আর রোশানের দৃষ্টিতে, ২৬ বছর ধরে চলমান যুদ্ধে বোমা মেরে নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য তামিল টাইগাররাই দায়ী।
তিনি বলেন, আমরা আগে একে অপরকে শত্রু ভাবতাম। এখন বিয়ে করে সুখেই আছি। আমাদের কন্যা আমাদের ভালোবাসার প্রতীক।
আগে একে অপরের মৃত্যু কামনা করতেন, এর মধ্যে এমন কী ঘটলো- যার কারণে এখন একে অন্যের জন্য প্রাণ দিতেও রাজি?
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) ক্রসিং ডিভাইডস নামে একটি নতুন অনুষ্ঠান শুরু করেছে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ভালোবেসে কাছে আসার গল্প তুলে ধরা হচ্ছে। এ অনুষ্ঠানেরই একটি পর্বে নিজেদের কথা বলেছেন গৌরি ও রোশান।
১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর ওপর তামিল টাইগারদের হামলায় ১৩ জন নিহত হলে দেশটিতে দাঙ্গা শুরু হয়। এতে হাজার হাজার সংখ্যালঘু তামিল নাগরিক নিহত হন।
দাঙ্গার প্রভাব পড়ে গৌরির জীবনেও। তবে, সবকিছু বদলে যায়, যখন তিনি জানতে পারেন, তার ভাইয়ের ট্রাক্টরে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে।
গৌরি বলেন, তামিল টাইগারদের ঘাঁটি বলে পরিচিত আমাদের গ্রাম বিশ্বমাদুর নিকটবর্তী সরকার-নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকা থেকে গোলাটি নিক্ষেপ করা হয়।
খবর শুনে ভাইকে খুঁজতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান কিশোরী গৌরি। সেখানে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তাকে এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গৌরি বলেন, আমি মানুষ হত্যা করতে দেখেছি। আমার এক বন্ধু বোমার আঘাতে আহত হয়। আমরা তাকে ওঠানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে বিষাক্ত সায়ানাইড ক্যাপসুল চিবিয়ে ফেলে। সে এত বেশি আহত হয়েছিল যে, বাঁচার কোনো আশাই ছিল না।
‘আমাদের গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, পর্যাপ্ত খাবার পেতাম না। সেসময় বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পেতাম না। ’
রোশানের জীবনে যুদ্ধের প্রভাব পড়ে ২০০৪ সালের দিকে, যখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। তার গ্রামে সিংহলিজ হিন্দু নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। গ্রামটি ছিল স্বাধীনতাকামী ও সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকার মাঝামাঝি ভাবুনিয়া জেলায়।
বোমা হামলায় সেনাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ মারা যাওয়ার প্রতিশোধ নিতে বাবা-ভাইদের সঙ্গে সিভিল সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন রোশান।
তিনি বলেন, প্রতিদিনই হামলার খবর পাওয়া যেত। একসঙ্গে সবাই মারা যাওয়ার ভয়ে লোকজন পরিবার নিয়ে কোথাও যেতে ভয় পেত। যুদ্ধে আমার এক ভাইও মারা গেছে।
২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত এতে অন্তত এক লাখ মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দুই পক্ষকেই অবৈধ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয়। এতে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি, যুদ্ধক্ষেত্রে শিশুদের ব্যবহারের জন্য বিদ্রোহীদের দায়ী করা হয়।
গৌরি প্রায় একমাস সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। পরে, হৃদযন্ত্রে সমস্যা আছে বুঝতে পেরে তাকে সরিয়ে দেন বিদ্রোহী নেতারা। এর পর পরই শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন গৌরি। বিদ্রোহীদের জন্য সরকারের পুনর্বাসন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া অনেকের মধ্যে তিনিও ছিলেন।
প্রথমে স্বাধীনতাকামীদের হয়ে লড়াই করলেও, সিংহলিজদের সঙ্গে থাকার পর গৌরি বুঝতে পারেন, এরাও তাদের মতোই সাধারণ মানুষ। ঘটনাক্রমে তিনিও সিভিল সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন।
এসময় উত্তরাঞ্চলীয় মানুষদের সাহায্যের জন্য বেশ কয়েকটি খামার গড়ে তোলে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে একটা ছিল উদয়ানকাট্টুতে, যেখানে ভবিষ্যৎ স্বামীর দেখা পান গৌরি।
২০১৩ সালে নিয়োগ পান গৌরি, রোশান সেখানে ছিলেন এর বছর খানেক আগে থেকেই। তামিল ভাষা না জানায় স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না রোশান, এতে অনেকটাই একা একা থাকতে হতো তাকে। এসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন গৌরি। তিনি রোশানকে তামিল ভাষা অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিতেন।
গৌরি বলেন, সে হয়তো একা বোধ করতো। আমি চেয়েছিলাম, সে যেন ঠিক থাকে, তাই মাধেমধ্যে বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে আনতাম।
এভাবে, দ্রুতই তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যান।
গৌরি বলেন, আমি বলেছিলাম, তাকে আমি তার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।
রোশান বলেন, আমি চলে আসার সময় সে (গৌরি) কাঁদছিল। সে এটাও চাইতো, জীবনযাপনের জন্য আমার কাছে যেন যথেষ্ট টাকা থাকে।
তাদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হতেই বিভিন্নভাবে বাধা আসতে থাকে। রোশানের আত্মীয়রা বলেন, এত সিংহলিজ থাকতে তামিল মেয়ের পেছনে কেন পড়লে?
বিয়েতে অমত করেন রোশানের মা। সাবেক তামিল টাইগার যোদ্ধা গৌরির বোনও এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান। তিনি ভাবতেন, তাদের কাছ থেকে গৌরিকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হবে ও স্বামী তাকে মারধোর করবে।
তবে গৌরি-রোশানের পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ স্বজনদের ভুল ভেঙে দেয়। ২০১৪ সালে বিয়ে করেন তারা।
গৌরি বলেন, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। মেয়ে জন্মের পর রোশানের মা অত্যন্ত খুশি হন। ছোট পরীটা আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে।
বর্তমানে গৌরির পরিবারের সঙ্গেই থাকছেন এ দম্পতি। তিনি জানান, আগে বাধা দেওয়া বোনের কাছেই রোশান এখন সবচেয়ে প্রিয় দুলাভাই।
এ দম্পতির কাছে বিভেদ এখন সুদূর অতীত। তাদের একমাত্র কন্যা সেনুলি চমালকা হিন্দু ও বৌদ্ধ দু’ধরনের মন্দিরেই যায়।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে বোমা হামলায় ২৫০ জনের বেশি নিহতের ঘটনায় মুসলিম-বিরোধী সহিংসতা শুরু হয়েছে। এতে দেশটিতে ফের দাঙ্গা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ দম্পতি।
গৌরি বলেন, যুদ্ধে শুধু এক পক্ষের লোকই মারা যায় না। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। দেশে আরেকটা যুদ্ধের কোনো দরকার নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৩ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৯
একে