মোটাতাজা শরীর। খোলা গা।
থলথলে শরীরের সঙ্গে থাকে পেটানো চুল। মাথার মাঝখানে ছোট্ট খোঁপা। কুতকুতে চোখ। চোখ খুলে মাটিতে রাখা নিজেদের পা দেখতে গেলে তাদের চোখের দৃষ্টি বেধে যায় ভুঁড়িতে। ভুঁড়ির ঠিক নিচে বাঁধা থাকে পেঁচানো মোটা কালো, বাদামি অথবা সাদা ধবধবে কাপড়। এখনই শুরু হবে খেলা। কয়েক কদম ধীরে হেঁটে মোটাতাজা দুজন দুদিক থেকে এসে দাঁড়িয়ে যায় গোল সীমানার মধ্যে। প্রস্তুত দুজন। একে অপরের দিকে শক্তিশালী দুটি হাত বাড়িয়ে দেয় মহিষের শিঙের মতো। করতালিতে কেঁপে ওঠে মঞ্চ। দর্শকরা সবাই একই সুরে বলতে থাকে সুমো-সুমো-সুমো।
হ্যাঁ, বন্ধুরা তোমরা নিশ্চয় সুমো কুস্তির নাম শুনেছো। দেখেছো মানুষরূপী দুটি পাহাড়ের মারামারি। মারামারির সময় দুটি ভুঁড়ির সংঘর্ষে দ্রাম, দ্রুম, দ্রুম শব্দও শুনেছো হয়তো। এই মানুষ দুটিকে দেখে তোমরা হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাও। ভাবো, মানুষ এতো মোটাতাজা হয়!
আবর হয়তো এটাও ভাবো, যারা নিজেদের শরীর নিয়েই নড়তে পারে না, তারা এমন করে কুস্তি করে কী করে! কবে থেকে শুরু হয়েছিল এমন অদ্ভুত খেলা? কী খায় ওই মানুষগুলো? কেমন করে হয় পাহাড়ের মতো এমন শরীর? কোনো চিন্তা নেই। এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে এখনই।
সুমো কুস্তির জন্ম জাপানে যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও আগে। এটি মূলত জাপানেরই খেলা। তৎকালীন জাপানি সম্রাটের সম্মানে হওয়া বলী খেলা উৎসবে জন্ম হয় সুমোর। ওই সময় এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো জাপানের বিখ্যাত সব পালোয়ানরা।
ধীরে ধীরে সুমো কুস্তি পরিণত হয় জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলায়। এ খেলার জনপ্রিয়তায় এতোটুকুও ছেদ পড়েনি ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত। কিন্তু হঠাৎ করে ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা। জাপানের তৎকালীন সম্রাট সুমুতোই কোসিমার জোর বিরোধীতার মুখে বন্ধ হয়ে যায় এই খেলা।
একটানা বন্ধ থাকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত। এর পর ১৯০৯ সালে দুজন বিখ্যাত সুমোবিদ হিটারিয়ামা ও উনিগ্রেতিনির বিশেষ আগ্রহে আবার শুরু হয় সুমো। মূলত এদের দুজনের উৎসাহ এবং চেষ্টায় তৎকালীন সম্রাট ইকো তৈরি করে দেন একটি স্টেডিয়াম। শুধু সুমো কুস্তিগীরদের জন্য তৈরি ওই স্টেডিয়ামটির নাম ছিল ককৃজিকান।
সুমো খেলোয়াড়দের জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘রিকিসি’। একজন রিকিসির অগণিত ভক্ত থাকে। যারা নতুন সুমো তাদের বলা হয় ‘মায়েজুমো’। আর যারা ভালো কুস্তি করেন তাদের ‘মাকুচিতা’, ‘জুরিও’, ‘মাকুউচি’, ‘মায়েজুমো’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়।
সুমো মূলত জাপানি খেলা হলেও ১৯৭২ সালের পর এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে চীন, শ্রীলংকা, তাইওয়ান, আমেরিকা, ব্রিটেন, তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ হাওয়াই-এ সুমো খেলা অর্জন করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। যা আজো অব্যাহত আছে।
বিশাল শরীরের অধিকারী হয় একজন সুমো কুস্তিগীর। এদের সবার উচ্চতা হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় ফুটের মতো। আর ওজন হয় দুই থেকে আড়াইশ কেজি। কি বন্ধুরা, অবাক হচ্ছো তাই না?
অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাদের শরীরের এমন গঠন শুরু হয় ছোটবেলা থেকেই। এজন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় তাদের। ওজন বাড়ানোসহ কুস্তির কায়দা-কানুন শিখতে হয় ওস্তাদের কাছে। এরা প্রতিদিন তিন-চার কেজি মাংস, ২০ থেকে ২৫টি ডিম, সমুদ্রের শৈবালের তৈরি খাবার, নারিকেলের পানি, স্কুইড, সামুদ্রিক মাছ প্রভৃতি খায়।
জাপানের মানুষের গড় আয়ু ৮৩ বছর। কিন্তু সুমোরা বাঁচে ৬০ থেকে ৬৫ বছর। ভারি শরীর এবং খাদ্যাভাসের কারণে তারা ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আথ্রারাইটিস প্রভৃতি রোগে ভোগে। ফলে তাদের বেশি দিন বেঁচে থাকা কঠিন হয়।
একটি বড়ো বৃত্তের মধ্যে খেলা হয় সুমো। বৃত্তটি মূল মাটি থেকে কিছুটা উঁচু থাকে। খেলা শুরু হওয়ার আগে একজন উপস্থাপক প্রতিযোগীর নাম, বয়স, ওজন বলে দেন। ঠিক সে সময়টাতে পুরো চত্বর প্রদক্ষিণ করে দুজন কুস্তিগীর গ্যালারিমুখো হয়ে দাঁড়ান। এরপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে ‘সব শয়তানের ধ্বংস হোক’ এই প্রার্থনা করে এবং নিজের জয়ের জন্য আশীর্বাদ চেয়ে ঢুকে পড়েন রিঙের মধ্যে। খেলা পরিচালনা করেন একজন রেফারি। তার সঙ্গে থাকেন পাঁচজন বিচারক। রেফারি প্রধানকে জাপানি ভাষায় বলা হয় গেয়জি।
সুমো কুস্তিতে প্রতিদিন খেলা হয় মোট ৩৫০টি বাউট বা রাউন্ড। প্রতিটি রাউন্ডের সময় মাত্র ৩০ সেকেন্ড। এক সুমোবিদ অন্য সুমোবিদকে যদি ঠেলে ওই রাউন্ড বর্ডার পার করে বাইরে নিতে পারেন, তবেই সে জিতে যায়। একটানা ১৫ দিন বিভিন্ন রাউন্ডে লড়াই করে যে সুমো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন তিনিই হন গ্রান্ড চ্যাম্পিয়ন।
কুস্তিগীর কিন্তু ইচ্ছেমতো তাদের শরীরেরর শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন না। এজন্য মানতে হয় অনেক নিয়ম-কানুন। সুমোর নিয়মে চোখে আঘাত, চুল ধরে টান, কুচচিতে এবং মুখে আঘাত, পা ধরে বাঁকা করা, ঘাড়ে জোরে আঘাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর এজন্য প্রত্যেক কুস্তিগীরকেই গ্যারান্টি স্বাক্ষর দিতে হয় খেলা শুরুর আগে। রেফারি ছাড়াও আরো পাঁচজন জজ বা বিচারক খেলা পর্যবেক্ষণ করেন। রিঙের চারপাশ থেকে যারা রেফারিকে ফলাফল নির্ধারণের জন্য সাহায্য করেন এদের মধ্যে একজন নিয়ন্ত্রণ করেন সময়। খেলা শেষে বিচারকরা পয়েন্ট হিসাব করে ফলাফল তুলে দেন রেফারির হাতে। রেফারি বিজয়ীর হাত উত্তোলন করে ঘোষণা করেন গ্রান্ড চ্যাম্পিয়ন।
সুমোকুস্তি মূলত দুধরনের। এর মধ্যে একটি ‘এমুনি’। অপরটি ‘বেল্ট ফাইটিং’। বেল্ট ফাইটিং সুমোই সবচেয়ে জনপ্রিয়। তোমরা হয়তো গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেছো ইয়া মোটা সুমো কুস্তিগীররা এতো কষ্টে লড়াই করে, এর বিনিময়ে তারা কী পায়। বা তারা তাদের শরীরের মতো মোটা অঙ্কের কোনো পুরস্কার পায় কিনা?
হ্যাঁ পায়। মূলত মোটা অঙ্কের অর্থই দেওয়া হয় বিজয়ীকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই অর্থের পুরোটাই বিজয়ীকে ব্যয় করতে হয় তার ভক্তদের পেছনে। এই রীতিটি চলে আসছে জাপানের বিখ্যাত সম্রাট মিইইজীর শাসনামল থেকে। মিইইজীর শাসনামল ছিল ১৮৬৮-১৯৮২ সাল পর্যন্ত।
যাই হোক, এই পুরস্কারের টাকাকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘জানা’। যার শাব্দিক অর্থ ফুল। ভক্তদের উদ্দেশে ওই টাকা ব্যয় করার সময় তার ভক্ত সমর্থকরা ফুল ছিটিয়ে অভিনন্দন জানায় তাদের পছন্দের খেলোয়াড়কে। এসময় তারা চিৎকার করে বলতে থাকে ‘হানা ইউরি দ্যাংগো’। যার অর্থ ভাত কিংবা পিঠার চেয়েও ফুল ভালো। পুরস্কারের অর্থ ছাড়াও সুমো কুস্তিগীররা পান একটি সম্মাননাপত্র, কাপসহ ৩০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি রূপার পদক। ওই পদকটি গলায় ঝুলিয়ে বিজয়ী সুমো কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ান স্টেডিয়াম চত্বরে। দর্শকরা তাকে দেখে চিৎকার করে বলতে থাকে সুমো-সুমো-সুমো।
তবে সরাসরি সুমো খেলা দেখার সৌভাগ্য খুব কম জাপানির ভাগ্যে জোটে। কারণ কোথাও সুমো খেলার আয়োজন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। তবে টিকেটের দাম অতি বেশি হওয়ায় তা থাকে সাধারণ দর্শকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]