ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

আয়ানের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবেদন ‘আইওয়াশ’: হাইকোর্ট

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৪
আয়ানের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবেদন ‘আইওয়াশ’: হাইকোর্ট

ঢাকা: রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড হাসপাতালে খতনা করার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া শিশু আয়ানের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনকে এক ধরনের ‘আইওয়াশ’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে প্রতিবেদনের সুপারিশকে হাস্যকর উল্লেখ করেছেন উচ্চ আদালত।

সোমবার (২৯ জানুয়ারি) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ মাসুম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কুমার দেবুল দে। আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারি দিন রেখেছেন।

এর আগে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে ১৫ জানুয়ারি নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

একইসঙ্গে রুলে আয়ানের পরিবারকে কেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

এ আদেশ অনুসারে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. পরিমল কুমার পালের সই করা ১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।

পরিমল কুমার পাল প্রতিবেদন থেকে বলেন, আয়ানের হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক ছিল। এনেসথেসিয়া দেওয়ার আগে আয়ানকে স্টেরয়েড দিয়ে নেবুলাইজেশন করানো হয়। প্রিকশান (পূর্ব সতর্কতা) হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

তখন আদালত বলেন, স্টেরয়েড দিয়েছেন! স্টেরয়েড ভালো মানুষকে দিলেও পার্শ্ব প্রতিক্রয়া হয়।

জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, স্টেরয়েডটা লাইফ সেভিং (জীবন রক্ষাকারী) গার্ড।

নিজের বাইপাসের কথা উল্লেখ করে আদালত বলেন, স্টেরয়েডে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবেই। যাদের বাইপাস হচ্ছে তাদেরও এত ওষুধ দেওয়া হয় না। বাইপাসের জন্য এত ওষুধ লাগে না। আপনারা (আয়ানের ক্ষেত্রে) যে ওষুধ দিয়েছেন।

এরপর রিটকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ প্রতিবেদনের কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেন, এই প্রতিবেদনটা যে কারসাজিপূর্ণ, তা হাতে-কলমে দেখাতে পারব।

তখন আদালত বলেন, এটা আপনাকে হলফনামা করে বলতে হবে।

প্রতিবেদনের মতামত অংশের অসঙ্গতি তুলে ধরে আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ বলেন, প্রতিবেদনে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আয়ান একজন অ্যাজমা রোগী। কিন্তু আয়ানের বাবা আগেই অ্যাজমা থাকার বিষয়টি বলেছেন। তাকে ইনহেলার দেওয়া হয়। বিষয়টি এক চিকিৎসকের জবানবন্দিতে আছে। এই প্রতিবেদনের সব কিছুই অনুমান। সবকিছুই প্রিজামশন করা হয়েছে।

এ পর্যায়ে আদালত প্রতিবেদনের সুপারিশ দেখিয়ে বলেন, খুবই হাস্যকর সুপারিশ। আর এটি (প্রতিবেদনটি) এক ধরনের আইওয়াশ। আপনি হলফনামা দেন আমরা আদেশ দেব।

আইনজীবী বলেন, এটি সম্পূর্ণ একটি কারসাজিপূর্ণ প্রতিবেদন। যে কারণে আমরা এ ঘটনার বিচারিক অনুসন্ধান চাইব।

আদালত বলেন, মেডিকেল নেগলিজেন্সের (চিকিৎসায় অবহেলা) জন্য একটি টিম গঠনের নির্দেশনা দেওয়া যায় কি না, আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আইনগতভাবে বা আমাদের নির্দেশনার মাধ্যমে এটা নিয়ে কিছু একটা করা যায় কি না।

পরে আদালত ১১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী আদেশের জন্য রেখে এ সময়ের মধ্যে রিটকারী পক্ষকে হলফনামা দিতে বলেন।

এরপর আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ মাসুম সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন দেখে আদালত কিছু মন্তব্য করেছেন। আর এই তদন্ত প্রতিবেদন দেখে আসলে এটা বোঝা যায়, হাসপাতাল ও চিকিৎসকের দায় এড়ানোর জন্য একটি ম্যানিপুলেটেড রিপোর্ট দিয়েছে। কোর্ট আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী আদেশের জন্য রেখেছেন। এবং আমাদের বলেছেন, বাংলাদেশে একটি মেডিকেল নেগলিজেন্স টিম করে দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দেবেন। এখন আমরা জুডিসিয়াল ইনকোয়ারির জন্য আবেদন করব।

শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর পত্রিকায় আসা খবরের ভিত্তিতে অভিযোগ তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি কমিটি গঠন করে। তদন্তে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো—আয়ানের বাবা শামীম আহমেদের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য, বাড্ডায় আয়ানের খতনা করার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য, গুলশানে আয়ানের চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য নেওয়া হয়।

ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩১ ডিসেম্বর সাঁতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে আয়ানের বাবা নিয়ে আসেন এবং সুন্নতে খতনা করান। সুন্নতে খতনা করানোর পর আয়ানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ওইদিনই ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড, গুলশান-২ এ প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে গত ৭ জানুয়ারি গুলশান-২ ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে আয়ান। ৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারকমূলে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে মতামতসহ প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশ দেয়।

প্রতিবেদনের মতামত অংশে চিকিৎসা ও ওষুধ সংক্রান্ত কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। আর শেষাংশে বলা হয়, ‘সুন্নতে খতনা অপারেশনে স্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছে বলিয়া ধারণা হয়। ’

আর সুপারিশ অংশে বলা হয়—
১) হাসপাতালে একাধিক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট নিয়োগ দেয়া।
২) রোগী ও রোগীর আত্মীয় স্বজনকে অ্যানেসথেসিয়া ও অপারেশনের ঝুঁকিসমূহ ভালোভাবে অবহিত করা।
৩) হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থা রাখা।
৪) সরকারের অনুমোদনের পরে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা।

গত ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।

১৫ জানুয়ারি আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ মাসুম জানিয়েছিলেন, সারা দেশে লাইসেন্স ও অনুমোদনহীন কতগুলো হাসপাতাল আছে, তার তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে (স্বাস্থ্যসেবা) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এছাড়া ১৫ বছরে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, সেই বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিন মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছে।

৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করানোর জন্য আয়ানকে সাঁতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান অভিভাবকরা। খতনা শেষ হওয়ার পর আয়ানের জ্ঞান না ফেরায় তাকে সেখান থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এর সাতদিন পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৪
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।