ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

জনগণ কি ক্ষমতার উৎস?

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৪
জনগণ কি ক্ষমতার উৎস?

আমাদের দেশের মতো সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সংবিধান নিয়ে এতো আলোচনা হয় না। আর এখানে যতো সংবিধান বিশেষজ্ঞ আছেন অন্য কোনো দেশে তা আছে কি-না সন্দেহ।

  কিন্তু এতো কিছুর পরও সংবিধান এখানে অবশ্য পালনীয় কোনো বিধিমালা নয়, বরং এটি রাজনীতিতে ইচ্ছাপূরণের কেতাব।

একাডেমিক্যালি বলতে গেলে সংবিধানতো রাষ্ট্রের পছন্দকৃত একটি জীবন প্রণালী। রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান। অ্যারিস্টটল আমাদের সেরকমই জানান দিচ্ছেন। সেই বিশ্বাসের ধারাবাহিকায় আজ সংবিধান আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য গাইডবই। তাই সংবিধান ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। তবে রাষ্ট্রের আধুনিকতা সংবিধানের থাকা না থাকার ওপর নিভর্র করে না, বরং একটি রাষ্ট্র তার গৃহীত সংবিধান কতটুকু মেনে চলে সেটাই বিবেচ্য। কতটুকু পবিত্র জ্ঞান করে সেটাই মূখ্য।  

এক সময় ছিল যখন রাজার আদেশই ছিল চুরান্ত বিধান। রাজার ইচ্চাই রাষ্ট্র ও আইন। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল রাজা বা রানীর ইচ্ছা ও আজ্ঞা পালন। কেবল রাষ্ট্রই নয়, আইনের উদ্দেশ্যও ছিল রাজার ইচ্ছা অনুযায়ী রাজ্যর কার্য সমাধা। অস্টিন আমাদের বলে গেছেন, Law is the command of the sovereignty। সাধারনের ইচ্ছা এখানে গৌণ বিষয়। সাধারনের কাজ হচ্ছে রাজা বা যার সার্বভৌমত্ব আছে তার আদেশ মেনে চলা। আরা সার্বভৌমত্ব কেবল রাজার জন্য। জনগণের সার্বভৌমত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রতিষ্ঠিত তো পরের কথা, সেই ধারনাই তখন সৃষ্টি হয়নি।

কিন্তু আজ আমরা জানি, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজা সংবিধানের অধীন। সার্বভৌমত্ব রাজার জন্য নয়, জনগণের জন্য। আমাদের সংবিধানও সে কথাই বলছে-অনুচ্ছেদ-৭। কাজেই ক্ষমতার প্রশ্নে জনগণই সার্বভৌম। রাজা নয়, শাসক নয়। আবার আইনের প্রশ্নে সংবিধান সার্বভৌম। সব আইন সংবিধানের অধীন।

আমাদের দেশে দুটোই বিদ্যমান। ক্ষমতার প্রশ্নে জনগণ সার্বভৌম। অন্যদিকে আমাদের দেশে সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব বিরাজ করছে(যদিও বাস্তবে নয়), সংসদীয় সার্বভৌমত্ব নয়।

সংবিধানের উপরোক্ত রূপরেখা সবদেশেই মোটামুটি এরকমই। পার্থক্য কেবল বাস্তবতায়। কোন দেশ কতটা মেনে চলে বা অবজ্ঞা করে।

সংবিধানে যে বিষয়গুলো থাকে বা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ইত্যাদি। রাষ্ট্রভেদে এই নীতিগুলোরও ভিন্নতা আছে। কিন্তু সাধারণভাবে একটি আদর্শ বা কল্যাণরাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু নীতি ও আদর্শ মেনে চলে।  

আমাদের সংবিধান জনগণকে সব ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের প্রারম্ভেও এই মালিকানার স্বীকৃতি মিলেছে চুরান্তভাবে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রের ক্ষমতার চুরান্ত মালিক হিসেবে জনগণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রে সেই নীতির অনুসরণ করা হচ্ছে কি-না সেটি একটি ঘটনার প্রশ্ন।

রাষ্ট্রের মালিকানার প্রথম প্রমাণ হলো একটি রাষ্ট্র তার কাঠামোর মধ্যে জনগণের অধিকারকে কতটুকু স্বীকার করছে। এই মারিকানার প্র্রথম নজির হলো ‘ভোটাধিকার’। এটি কেবল নির্বাচনে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করা নয়, এর তাৎপর্য আরো ব্যাপক। এটি জনগণের রাজনৈতিক অধিকার। রাজনীতি তথা রাষ্ট্রের দিক নির্দেশনামূলক একটি কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নাগরিকরা রাষ্ট্রের মালিকানার অধিকার প্রয়োগ করে। সেকারণেই আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্চেদ কেবল নয়, আরো অনেক অনুচ্ছেদেই ভোটাধিকারের বা জনগনের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সর্বশেষ নির্বাচনে সংবিধানের সেই নীতির বাস্তবায়ন হয়নি। কেন হয়নি সেটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু এটি একটি বাস্তবতা ।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যখন জনগনের ক্ষমতার জয়, তখনই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য আমরা কিছুটা পশ্চাদগামী হলাম।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, মালদ্বীপ এমনকি শ্রীলঙ্কাও পদ্ধতিগত গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেছে। আরব তথা ল্যাটিন আমেরিকায় চলছে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের উৎসব।

আমরা যদিও সাংবিধানিকভাবে ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতির গণতন্ত্রের কথা বলি। কিন্তু বাস্তবে আমরা তার অনুসরণ করি না।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পারেনি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে আমাদের নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি।

বিচার বিভাগ আইনত স্বাধীন হতেও জনগণ প্রকৃত স্বাধীন বিচার বিভাগের সুফল থেকে বঞ্চিত। ন্যায় বিচার এখানে একটি কঠিন, ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

এখানে রাজা প্রথম চার্লসের ভূমিকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষমতাধরদের দেখা যায়। কিন্তু জনগনের অধিকার তথা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কাউকেই আমরা অলিভার ক্রমওয়েলের ভুমিকায়  অবতীর্ণ হতে দেখিনা।

আমাদের বিদ্যমান বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নের সুরাহা না হওয়াতে গণতন্ত্র, সাংবিধানিকতা ও মৌলিক অধিকারের মতো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আজো নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে, জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সুদূর পরাহত।

বাংলাদেশ সময়:  ১৭১৭ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।