ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

আত্মজবানীতে বঙ্গবন্ধু

এরশাদুল আলম প্রিন্স | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৪
আত্মজবানীতে বঙ্গবন্ধু

আজীবন গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার আর শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াকু এক সৈনিকের নাম শেখ মুজিব। কৈশরের খোকা থেকে যৌবনের শেখ মুজিব, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ও সেখান থেকে জাতির জনক হয়ে ওঠার যে সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ তার প্রতিটি স্তরেই তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন মানুষের প্রতি অবিচল আস্থা ও দেশাত্ববোধের।



গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সে স্বপ্নযাত্রা থেকে তিনি একচুলও বিচ্যুত হননি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর  প্রতিটি অধ্যায়েই বঙ্গবন্ধুর গৌরবময় উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। অবশেষে তাঁরই নেতৃত্ব ও জনগণের সংগ্রামের ফসল হিসেবে পৃথিবীর বুকে রচিত হলো একটি মানচিত্র---বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর কিছু আত্মজবানীতে নানাভাবে উঠে এসেছে সেইসব সংগ্রাম মুখর দিনগুলোর কথা। যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শনের কথা। এসব জবানীতে একইসাথে প্রতিভাত হয়েছে সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক কর্মসূচীর নানাদিক।

আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হলো ছয়দফা। এই ছয়দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু (তখনো ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব তিনি পাননি)বলেছেন, “আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ৬ দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। ফলে ৬ দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে। ” একই পুস্তিকার শেষে তিনি বলেছেন, “পূর্ব পাকিস্তানীদের ভালোবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যেকোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কা্ছে আমার মতো নগন্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু আছে বলিয়া আমি মনে করি না।   (৬-দফার ব্যাখ্যা সম্বলীত পুস্তিকা)

এ পুস্তিকাটির মাধ্যমে যে কেবল ৬ দফা নিয়ে তাঁর অভিমত বা মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তাই নয়, বরং, এদেশের জনগণের প্রতি  আস্থা ও ভালোবাসার কথা উঠে এসেছে বারবার। তাঁর প্রাণে সাহস আর বুকে বল সঞ্চারণের প্রধান নিয়ামক জনগণের ভালোবাসা ও আস্থা। সেই বিশ্বাসের প্রতি তিনি অবিচল থেকেছেন তারঁ জীবনের শেষ মুহুর্তটি পর্যন্ত। বাঙালির প্রতি এই অবিচল বিশ্বাস নিয়েই তিনি জীবনের ওপারে চলে গেছেন।
তবে তিনি তাঁর সংগ্রাম মুখর জীবনের সংক্ষিপ্ত বয়ান করেছেন ভিন্ন এক ‘জবানবন্দী’তে। যেটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার  জবানবন্দী হিসেবে আজও একটি ঐতিহাসিক দলিল।

এখানে তিনি তাঁর বিদ্যালয় জীবনের রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে শুরু করে পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীর কথা নিজেই বর্ণনা করেছেন আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দীতে। এক জায়গায় তিনি বলেন, “স্বাধীনতাপূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আমাকে লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে”।

এরপর তিনি একে একে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৫৪ সালে প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দের বছর কাল বিনা বিচারে আটক থাকা, ১৯৬২ সালে শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে গ্রেফতার ও ছয় মাস বিনা বিচারে আটক- এসব রাজনৈতিক হয়রানী ও নির্যাতনের কথা উঠে এসেছে ওই জবানবন্দীতে।

১৯৬৪ সালে তাঁর দলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতের সমালোচনা ও বিরোধীতা এবং ৬ দফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচী ও দর্শনের একটি জীবন্ত বর্ণনা দেখতে পাই ওই জবানবন্দীটিতে।

জবান বন্দীর এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “দেশের জন্য আমি যাহাই মঙ্গলকর ভাবিয়াছি আমি সর্বদা তাহাই নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভীতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং সেই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগোষ্ঠীর এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। ”

১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী একটি সম্মেলনের বক্তৃতায় বলেছেন, (১০ মার্চ ১৯৬৯) ... “আজ বিপন্ন বলিতে যাহা তাহা হইলো আমাদের সমগ্র জাতীয় স্বত্তা। এই প্রতীতিই আমাদের আজ জাতীয় জীবনের মূল সমস্যাগুলির বিস্তারিত একটি সমাধান নিদের্শের তাগিদ দিতেছে। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কণ্ঠে যে সব দাবী দাওয়া আজ ধ্বনিত হইতেছে, যত্ন সহকারে সেগুলি পরীক্ষা করিলে দেখা যাইবে যে উহার মূলে মাত্র তিনটি মৌল প্রশ্ন নিহত। রাজনৈতক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার অবলুপ্তি, সীমাহীন অর্থনৈতিক অন্যায় অবিচায়---যাহার ধকল পোহাইতে হইতেছে এদেশের শ্রমিক, কৃষক, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষকে—মোট কথা আপামর জনসাধারণ ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অবিচার”।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন স্মরণে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে দেয়া একটি বক্তব্যে বলেন, “এই ঐতিহাসিক দিনে আমি বাংলার গণমানুষকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই, শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ বাংলার মাঠে-ময়দানে বাঙ্গালীর দুয়ারে দুয়ারে ফরিয়াদ করিতেছে। শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ও দাসত্বের শৃঙ্খলমোচনের উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি বাংলার স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার যে মহান সংগ্রামে তারা আত্মাহুতি দিয়াছেন, সেই সংগ্রাম সফল করিয়া তোলাই হইবে তাদের স্মৃতির প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য”। ”

১৯৭০এর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি বলেন, “আমার দেশবাসী, আপনাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরও যদি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের  প্রতিনিধিগণ দেশের  ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে পাকিস্তান বিশেষ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিরতরে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হবে। ” কাজেই এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করাই ছিল তার নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা। ক্ষমতার মসনদের আরোহনের তাঁর কোনো অভিলাস ছিলনা। বরং জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার মূল প্রতিপাদ্য।

১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর একটি বক্তৃতায় বললেন, “ সারা পাকিস্তানে বাইশটি পরিবার জনগণের রক্তের ওপর সমৃদ্ধি লাভ করলেও, তারা এখনো ঘর্ণিঝড়ে ছিন্নমুল মানুষদের উল্লেখযোগ্য সাহায্য কিছুই পাঠায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড়ের কলের মালিকরা প্রধান বাজার হিসেবে বাংলাদেশকে শোষণ করলেও মৃতদেহের কাফনের জন্য এক টুকরে কাপড়ও দেয়নি। বাংলাদেশ আর কারো উপনিশে হয়ে থাকবে না। তারা নিজেরাই ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করবে। স্বাধীনতার অব্যক্ত সূরটি তাঁর অন্তরে বহুদিন থেকেই অনুরণিত হচ্ছিল। তাঁর নেতৃত্ব ও সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য থেকেই প্রকাশিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার সূর্যপতাকা।  

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে (সত্তুরের দশকে)তিনি বলেন, “ভায়েরা আমরা, চরম সংগ্রামের জন্য আপনাদের প্রস্তুত থাকবে হবে, ষড়যন্ত্রের ফলে গণতন্ত্র যদি ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়, আমি আপনাদের ডাক দেব। সেদিন আপনাদের চরম সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এই ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে আমি যদি চিরতর আপনাদের ছেড়ে যাই, আমরা মৃত্যুর পর বঞ্চিতা দেশমাতৃকার আর গরীব দু:খিনী মানুষের মুখের দিকে চেয়ে আপনার কি পারবেন আন্দোল করে দাবি আদায় করতে?”

কি নিদারুন আকুতি প্রকাশিত হয়েছে তার এই বক্তব্যে। ষড়যন্ত্রকারীদের থেকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর আহ্বান ও দেশ মাতৃকার মুক্তির আহ্বান-এই দুয়ের মাঝেই তাঁর সংগ্রামী জীবন।     

জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় শাসকদের টাল বাহানা চলছিল। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আমাদের  দেশের মানুষ পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা আর শোষিত  কলোনী হয়ে থাকবে না। তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হতে প্রতিজ্ঞাবন্ধ। ”

এছাড়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি বাক্য পৃথক রচনা ও গবেষণার দাবী রাখে।

স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী আরো নানা লেখনি ও বক্তব্যে এভাবেই ফুটে উঠেছে বাংলার মানুষের মুক্তির মহাকাব্য ও সেই মহাকবির দীর্ঘ সাধনার ইতিবৃত্ত।

আরেকটি লিখিত বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য বটে। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, ...“ তাই বলি, বাংলা আর বাঙালির ইতিহাস-সিরাজদৌলা বনাম মীরজাফরের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস বাংলার আপামর মানুষ বনাম জনাব মোনেম খাঁদেরই ইতিহাস। ” হায়! জনক, রক্ত দিয়ে কি তুমি তাই প্রমাণ করে গেলে?

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।