ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘অস্ত্রসহ ব্যাগ নিয়ে ৩/৪জন হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৯
‘অস্ত্রসহ ব্যাগ নিয়ে ৩/৪জন হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে’ হলি আর্টিজানে হামলার দিন রেস্তোরাঁয় ছিলেন হাসনাত করিমের স্ত্রী। ফাইল ফটো

ঢাকা: গুলশানের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিহত সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলামের দুই ভাইসহ এক নারী ক্রেতা সাক্ষ্য দিয়েছেন আদালতে। সাক্ষ্যে ঘটনার দিনের ভয়াবহ বর্ণনা তুলে ধরেছেন প্রত্যক্ষদর্শী ওই নারী ক্রেতা। 

বুধবার (০৬ ফেব্রুযারি) ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে মামলার ২০তম সাক্ষ্য হিসেবে তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।  

সাক্ষ্য দেন নিহত এসি রবিউল ইসলামের ছোটভাই শামসুজ্জামান ও খালাত ভাই আনোয়ার হোসেন এবং রেস্তোরাঁর ক্রেতা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীন।

অন্যদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য মঙ্গলবার (১২ ফেব্রুয়ারি) পরবর্তী দিন ধার্য করেন আদালত।  

২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই রেস্তোরাঁয় হামলার পর অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন ডিএমপির তৎকালীন এসি রবিউল।

আদালতে শারমিনা পারভীন বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টার দিকে আমার স্বামী হাসনাত করিমসহ ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ওই হোটেলে (রেস্তোরাঁ) যাই। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা সেখানে ডিনার করতে গিয়েছিলাম। হোটেলে ঢুকে সেখানকার হল রুমের টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মেন্যু দেখে খাবারের জন্য অর্ডার দিই।  

‘এর ৩/৪ মিনিট পরেই দেখি- তিন/চারজন অস্ত্রসহ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করে। প্রবেশ করা মাত্রই তারা গুলি করতে থাকে। এরপর আমাদের টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে-আপনারা মুসলিম? আমরা মুসলিম জানালে তারা বলে, আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আপনারা মাথা নিচু  করে টেবিলে বসে থাকুন। ’

মামলার চার্জশিট থেকে বাদ যাওয়া হাসনাত করিমের স্ত্রী বলেন, ‘ওই হোটেলের কাঁচের গ্লাস ঘেরা রুমে আনুমানিক ৮/১০ জন বা তার বেশি ফরেনার/বিদেশি বসে ছিলেন। কাচের গ্লাস ঘেরা রুমে ঢুকে তারা গুলি করতে শুরু করে। তখন আমাদের বলতে থাকে, আপনাদের ছেলে-মেয়েদের চোখ-কান বন্ধ করে রাখুন যেন, তারা কোনো কিছু দেখতে বা শুনতে না পায়। তারা দেখে ভয় পেতে পারে। তখন আমি আমার ছেলে-মেয়ের চোখ-মুখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। ’

‘ওই ঘটনার কিছুসময় পরই তারা একটি ছেলে ও একটি কম বয়সী মেয়েসহ ৪ জনকে আমাদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। তখন বারান্দার একটা লাইট ছাড়া সব লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটার এবং একজন ফরেনারকে বের করে নিয়ে আসে তারা। ওয়েটারকে সরিয়ে দিয়ে ফরেনারকে গুলি করে। এরপর আমাদের আশ-পাশে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। ’

শারমিনা পারভীন বলেন, ‘তখন ছিলো রমজান মাস। তাই সেহেরির সময় তারা আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সেই সময় খাবার খাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। এরপরও সামান্য কিছু খাবার খেয়ে সেহেরি শেষ করি। ভোরের দিকে আমার স্বামী এবং আরেকটি ছেলে তাহমিদকে ছাদে নিয়ে যায় তারা। এর কিছু সময় আবার তাদের একই টেবিলে নিয়ে এসে বসায়। আমার স্বামীকে চাবি দিয়ে বাইরের গেটের তালা খুলে আসতে বলে। তালা খুলে আসার পর বলে- আপনারা একজন একজন করে বের হয়ে যান। বের হয়ে আসার আগে মোবাইলসহ যা যা নিয়েছিল তা ফেরত দেয়। বের হওয়ার পরপরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপদে নিয়ে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী  আমাদের ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ’

এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি হলি আর্টিজান বেকারির হিসাব রক্ষক আরিফ হোসেন সাক্ষ্য দেন। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে গত ২০১৬ সালের ১লা জুলাই।

বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করা ওই ঘটনায় জঙ্গিরা ওই রাতে ২০ জনকে হত্যা করে; যাদের ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপান, ৩ জন বাংলাদেশি এবং একজন ভারতীয় নাগরিক।  

এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশও প্রাণ হারায়। পরে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী পাঁচজনও নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়; যাকে পরবর্তীতে হলি আর্টিজানের কর্মচারী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।

এ হামলা মামলার আসামিরা হলেন- হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।

আসামিদের মধ্যে প্রথম ছয়জন কারাগারে; দুইজন পলাতক। তবে কারাগারে থাকা ছয়জনকে বুধবার আদালতে হাজির করা হয়।  

গতবছরের ২৩ জুলাই আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তবে ‘আলোচিত’ হলেও ওই ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের ৮ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে আদালত চার্জশিট গ্রহণ করার পর ২৬ নভেম্বর এ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়।  

এদিকে সম্প্রতি এ মামলার পলাতক আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে গত ১৯ জানুয়ারি রাতে গাজীপুরের বোর্ডবাজারের একটি বাস থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। আর আব্দুস সবুর খান ওরফে হাসান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে খালেদকে ২৫ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল থেকে গ্রেফতার করা হয়।  

পলাতক দুইজনকে সবুজবাগ ও খিলগাঁও থানার পৃথক দুটি মামলায় রিমান্ডের আদেশ দিলেও এখনও পর্যন্ত হলি আর্টিজান হামলা মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখায়নি পুলিশ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৯
এমএআর/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।