ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

শৈশবের নির্যাতন ও ধারাবাহিক উত্ত্যক্তের জেরে খুন করে শিশুটি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২০
শৈশবের নির্যাতন ও ধারাবাহিক উত্ত্যক্তের জেরে খুন করে শিশুটি প্রতীকী ছবি

ঢাকা: মাত্র আট বছর বয়সে শিশুটি প্রতিবেশী রাফিজ উদ্দীনের (ছদ্মনাম) বলাৎকারের শিকার হয়। শিশুটি ভয় ও লজ্জায় তখন কাউকে কিছু বলতেও পারেনি।

এরপরেও তাকে বহুবার উত্ত্যক্ত করেছে রাফিজ উদ্দিন। একপর্যায়ে শিশুটির মনের ভাবনার জগতে পরিবর্তন ঘটে, ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে রাফিজ উদ্দীনকে খুনের শপথ নেয় শিশুটি।

বেশ কয়েকবার নিজে আত্মহত্যার চিন্তা করলেও পেরে ওঠেনি শিশুটি। কৈশোর পেরিয়ে গেলেও উত্ত্যক্তের প্রতিবাদে একপর্যায়ে রাফিজ উদ্দীনকে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করে ছেলেটি। পরে নিজেই ধরা দেয় পুলিশের হাতে। আদালতে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলে সে। এরপর ছেলেটি বলে ওঠে, 'সত্য ঘটনা বলায় এখন বুকের ভিতরটা হালকা লাগছে। '

গত বছরের মার্চে শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার সালধা মাঝপাড়া গ্রামে রাফিজ উদ্দীন প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে খুন হন। তিনি সকাল বেলা নিজ বাড়ির চারশ গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়ির পেছনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এ ঘটনায় গত বছরের ১১ মার্চ ঝিনাইগাতী থানায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে একটি মামলা (নং-৩) দায়ের করেন। মামলায় পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিবেশীকে ফাঁসানোর চেষ্টাও করা হয়। থানা পুলিশ ঘুরে মামলার তদন্ত ভার যায় পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। তদন্তের একপর্যায়ে বেরিয়ে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লোমহর্ষক এ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।

শেষে তিনি প্রশ্ন রাখেন- আমরা মেয়ে শিশুর নিরাপত্তার কথা কম-বেশি সবাই ভাবি, কিন্তু ছেলে শিশুদের? অনেকে হেসেই উড়িয়ে দেই। পরিচিত বিশ্বস্ত মানুষদের দ্বারাই এসব ঘটনা ঘটে। কিন্তু যে ছেলে শিশুটির বেলায় এ ঘটনা ঘটে গেল, সারা জীবনের জন্য তার যে মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটল, তার কি কোনো সমাধান আছে?

স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘নালিতাবাড়ী পুরান বাজারটি বেশ বড়। সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেটি বাস থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকায়। অন্যদের মতো বাজারে ঘুরে বেড়ায়। ছোটখাটো কিছু কেনার জন্য এদিক-ওদিক যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে ক্রমে রাত বাড়ে। বাজারটিও আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়। ছেলেটির কোনো তাড়া নেই। সে একা একটি বেঞ্চে বসে থাকে। শেষ রাতের দিকে চৌকিদারের ধৈর্য ভেঙে যায়। খবর দেয় থানায়। টহল পুলিশ দলটি ছেলেটির নাম-ঠিকানা নিয়ে সন্দেহ করে। শরীর তল্লাশি করে পকেটে পাওয়া যায় এক বোতল কীটনাশক বিষ। বিষ দিয়ে কি করবে? বলে বিষ খাবে! পুলিশের কৌতুহল আরো বাড়ে। ছেলেটি জানায়, সে একটা খুন করেছে।  

এজাহার বা এফআইআর (First Information Report) আদালতে মামলা প্রমাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য। বৃটিশ আইন প্রণয়নকারীরা বিশ্বাস করতেন, ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি প্রথম যখন পুলিশের কাছে যায়, তখন সে তার জানামতে সত্যি কথা বলে। তাই তার বক্তব্য মামলার এজাহার হিসেবে রেকর্ড হওয়ার পর এজাহারদাতা বা অন্য কেউ, এমন কি পুলিশও কোনোভাবে এটি কাটা- ছেড়া করতে পারে না। এজাহার যত সত্যের কাছাকাছি হয় ততই মামলার জন্য মঙ্গলজনক।  

গত বছর মার্চ মাসে শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার সালধা মাঝপাড়া গ্রামে রাফিজ উদ্দীন প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে খুন হন। তিনি সকাল বেলা নিজ বাড়ির চারশ গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়ির পেছনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।  

স্বাভাবিকভাবে খুনের দায় পড়ার কথা প্রতিবেশী বাড়ির লোকজনের উপর। হয়ও তাই। তারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালায়। লুটপাট হয় সবকিছু। ভিটায় ঘুঘু চড়ে। ভিকটিমের ভাই মাহিজউদ্দিন থানায় খুনের এজাহার দেন। এজাহারে তিনি কখন, কোন স্থানে, কার সহায়তায় কে কে কীভাবে খুন করেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। এজাহারে আরো দাবি করা হয়, সে সহ অন্যরা চিৎকারে দৌড়ে গিয়ে নিজ চোখে দেখেছে এজাহারে বর্ণিত ঘটনা। পুলিশের ভাষায় এটি একটি সহজ খুনের মামলা। তদন্তকারীর কাজ হলো ২-৪টা আসামি ধরা, সাক্ষীদের বক্তব্য নেয়া এবং আদালতে অভিযোগপত্র (CS- Chargesheet) দেয়া।

গোল বাধে মামলার তদন্তে নেমে। আসামির মধ্যে চারজনই মহিলা। এলাকায় সাক্ষী সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়- একদল এজাহারের বক্তব্য গড় গড় করে বলে এবং অন্যদল কিছুই দেখে নাই। দ্বিতীয় দলটি অপেক্ষাকৃত ছোট। কেন খুন হলো? তার উত্তরও প্রস্তুত। আসামিদের বাড়ির একজন বয়স্ক মহিলার সঙ্গে রাফিজউদ্দিনের পরকীয়া ছিল, তাই। নিরপেক্ষ সাক্ষী আর জোগাড় হয় না। পুলিশ পড়ে যায় মহা ফাপরে। দশজন আসামির মধ্যে শুধুমাত্র মা ও ছেলেকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (Chargesheet) দেয়া হয়। বাদী ও সাক্ষীদের যে দাপট তাতে নির্ঘাত ফাঁসি। মৌখিক সাক্ষ্য নির্ভর ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থাপনায় এটা একটা দূর্বলতা।  

বাদী খুশি নন, না হবারই কথা। এমন অকাট্য চাক্ষুষ প্রমাণজনিত খুনের আটজনই বাদ? মগের মুল্লুক নাকি? তিনি আদালতে তদন্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। মামলা চলে আসে পিবিআই’তে। পিবিআইও দৌড়াতে থাকে।  

গ্রামের রেওয়াজ অনুযায়ী কারো বাড়িতে রাতে কখনো ঘুমের তাৎক্ষনিক অসুবিধা হলে মানুষ প্রতিবেশীর বাড়িতে ঘুমাতে যান। প্রায় একযুগ আগে রাফিজউদ্দিন প্রতিবেশীর বাড়িতে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। ঘুমান ঐ বাড়ির ৮ বছরের ছেলে শিশুটির সঙ্গে। তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় ছেলেটিকে বলাৎকার করেন। ছোট ছেলেটি ভয় ও লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না। তার মনের ভাবনার জগতের পরিবর্তন ঘটে। ভাবনায় ঠায় পায় যদি তার পেটে বাচ্চা হয় তখন সে কি করবে? সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিশপ্ত হবে? সবাই কি বলবে? 

পড়াশুনায় মনোযোগী ছেলেটি ক্রমান্বয়ে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। দেয়া হয় মাদ্রাসায়। এক বছর পর সেখান থেকেও তাকে চলে আসতে হয়। রাফিজ পুনরায় বলৎকারের সুযোগ খোঁজে। শিশুটি বাবা-মা’র কাছ থেকে নড়ে না। সে আত্মহত্যার কথা ভাবে। কিন্তু নিয়ম তো জানে না। ঠিক করে প্রতিশোধ নেবে। রাতে সবাই ঘুমালে মাঝে মাঝে রান্না ঘরে যায়। মায়ের বটি’টা ধরে বসে থাকে। ভাবে রাফিজকে খুন করার পর বাড়িতে ফেরার সময় অন্ধকারে যদি জ্বীন বা ভূত ধরে, তাহলে কি হবে? পরম করুনাময়কে সাক্ষী রেখে শিশুটি একদিন কলম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে ওকে খুন করবেই।  

ছোটবেলায় মানুষের জীবনে কত কিছু না ঘটে- সময় সব কিছু ঠিক করে দেয়। এখানেও ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা বাঁধল রাফিজ সদ্য কৈশোরে উপনীত ছেলেটিকে একা পেলেই শৈশবের কুৎসিত সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে আতঙ্কিত হয়।  ছেলেটি বাবার কথা বলে বাজার থেকে দুই-তিনবার কীটনাশক কিনে আনে। গোপনে বিষের বোতল দুই হাতে নাড়াচাড়া করে, কিন্তু খাওয়া হয় না। এর মধ্যে বুঝে গেছে আত্মহত্যা মহা পাপ। মহাপাপের কাজ করা থেকে অভিশপ্ত থাকাই ভালো। উত্তম যদি প্রতিশোধ নেয়া যায়। একসময় সে রাফিজকে শাসিয়ে দেয় তাকেও পেছন থেকে মারবে।  

এত কিছুর মধ্যে ছেলেটি চিন্তা করে এসএসসি পরীক্ষা শেষে ময়মনসিংহ বা ঢাকা চলে যাবে। আর কখনো গ্রামে ফিরে আসবে না। তা হলে সবদিকই রক্ষা। একটু বেশি বয়সেই সে পরীক্ষায় বসে।  

পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র পাঁচ দিন আগে। রাফিজ সকাল বেলা তার দুই বছরের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে যাবার সময় কৈশোর পার হওয়া সদ্য যুবকটিকে তাদের বাড়ির পিছনে দেখে। আবার টিটকারী মারে, অশ্লীল ইঙ্গিত করে। এবার সে আর সহ্য করতে পারে নাই। মনে পড়ে শিশুকালের সেই প্রতিজ্ঞার কথা, কিশোর বয়সে পেছন থেকে মারার হুঁশিয়ারির কথা। সে ঘর থেকে একটা দা এনে রাফিজের পেছন থেকেই কোপ মারে। পর পর কয়েকটি কোপ মাথায় লাগার পর সে দা ফেলে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম চলে যায়। কাজ নেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঠিকাদারের রাজমিস্ত্রী হিসেবে।  

ইতোমধ্যে সে জেনেছে, পুলিশ তাকে ও তার মা’কে খুনের মামলার আসামী করে অভিযোগপত্র দিয়েছে। মায়ের জন্য তার খুব কষ্ট হয়। সে কাজ ছেড়ে দেয়। নালিতাবাড়ি বাজারে এসে আবার দ্বিধায় পড়ে। সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে না বাড়িতে যাবে! বাড়িতে গেলেই পুলিশ আসবে। পুলিশের কাছে অন্তত জীবনের গোপন কথাগুলি বলতে পারবে। আদালতে সে বলে, 'সত্য ঘটনা বলায় এখন বুকের ভেতরটা হালকা লাগছে। ' খুনের জন্য তার কোনো আফসোস নেই।

"দণ্ডিতের সঙ্গে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার"। ছেলেটির জন্য কষ্ট হয়। মনের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ করেই সে শিশু ও কৈশোর কাল পার করেছে। এ যুদ্ধ ছিল তার নিজের সঙ্গে। '

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২০
পিএম/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।