ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘বই প্রকাশের দায়ে যারা হত্যা করে, তারা সমাজ-রাষ্ট্রের শত্রু’

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১
‘বই প্রকাশের দায়ে যারা হত্যা করে, তারা সমাজ-রাষ্ট্রের শত্রু’ কড়া পুলিশি প্রহরায় আদালতে নেওয়া হয় দীপন হত্যা মামলার আসামিদের | ছবি: ডিএইচ বাদল

ঢাকা: ‘জিহাদের নামে ব্লগার ও লেখকদের হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দেওয়া এবং রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে বিনষ্ট করা। বই প্রকাশের দায়ে যারা হত্যা করে, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু।

জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এ মন্তব্য করেন।

বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় দেন। রায়ে মামলার আট আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া আসামিদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।

আরও পড়ুন: দীপন হত্যা মামলায় ৮ আসামির মৃত্যুদণ্ড

রায় ঘোষণা উপলক্ষে এ দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে গ্রেফতার ছয় আসামিকে আদালতে আনা হয়। এ সময় তাদের কোর্ট হাজতে রাখা হয়। বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়।

বিপুলসংখ্যক পুলিশ বেষ্টনিতে একে একে ছয় আসামিকে এজলাসে আনা হয়। এ সময় তাদের গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট পরানো ছিল। আসামিদের কাঠগড়ায় তোলার আগেই এজলাস কক্ষ মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করা হয়।

এরপর মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বল্পসংখ্যক আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীকে দেহ তল্লাশির পর এজলাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমানসহ তিন স্বজন রায় শুনতে এজলাস কক্ষে হাজির হন। বেলা ঠিক ১২টার দিকে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপরই রায় ঘোষণা শুরু করেন। ৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের শুধু সারাংশ পড়ে শোনান বিচারক।

এ সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সংহতি বিনষ্ট করতে এবং দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয় তারা আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেশের গণতন্ত্র ও সংহতিকে বিপন্ন করতে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।

আদালত বলেন, জিহাদের অংশ হিসেবে লেখক ও ব্লগারদের হত্যা করা হয়। যার উদ্দেশ্য হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করা এবং রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে বিনষ্ট করা। বই প্রকাশের দায়ে যারা দীপনকে হত্যা করেছে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দীপনকে হত্যা করে। তাই এই আসামিরা অনুকম্পা পেতে পারে না। মৃত্যুদণ্ডই তাদের উপযুক্ত শাস্তি। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে নিহতের আত্মা শান্তি পাবে এবং অন্যরাও এখান থেকে শিক্ষা নেবে।

তাই আসামিদের সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ (সংশোধন ২০১৩) এর ৬(২)(অ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো।

রায় ঘোষণার পর দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান এজলাস কক্ষে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। বেলা সোয়া ১২টার দিকে বিচারক রায় ঘোষণা করে এজলাস ত্যাগ করেন। এরপর প্রথমে আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীরা বেরিয়ে যান। এরপর আসামিদের আবার কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রিজন ভ্যানে করে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে দীপনের স্বজনরা আদালত চত্বরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

এই মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন—মইনুল হাসান শামীম, আ. সবুর, খাইরুল ইসলাম, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, শেখ আব্দুল্লাহ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব। এর মধ্যে মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব পলাতক। কারাগারে থাকা সব আসামিই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্টপক্ষের আইনজীবী ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় হয়েছে। আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট।

রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আপিলের কথা জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী এম এ বি এম খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। ঘটনাস্থলে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না, উচ্চ আদালতে আসামিদের আপিল করার অধিকার আছে। সে অনুযায়ী উচ্চ আদালতে গিয়ে আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩১ নভেম্বর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুবৃত্তরা। ওই দিনই তার স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন।

২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রে‌ট আদালতে দীপন হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমান। অভিযোগপত্রে ৮ জনকে অভিযুক্ত ও ১১ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।

২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

২০১৯ সালের বছর ১ ডিসেম্বর এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সেদিন মামলার বাদী ও দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান ও জব্দ তালিকার সাক্ষী আজিজ সুপার মার্কেট কো-অপারেটিভ মালিক সমিতির অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন আদালতে সাক্ষ্য দেন। মামলায় ২৬ সাক্ষীর ২৩ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১
কেআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।