ঢাকা: স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়। তাকে হত্যার উদ্দেশ্য হলো—জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ করতে না পারে।
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এ মত দেন।
মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এই রায় দেন।
রায়ে বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সাইমুম, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনানকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া মামলার অপর আসামি শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসামিদের মধ্যে মেজর জিয়া ও আকরাম পলাতক।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অভিজিৎ রায় একজন বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার ছিলেন। বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের আড্ডায় অংশ নিয়ে ফেরার পথে আক্রমণের স্বীকার হন। নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অর্থাৎ মামলার অভিযুক্তরাসহ মূল হামলাকারীরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে। তাকে হত্যা উদ্দেশ্য হলো—জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ করতে না পারে।
রায়ে আরও বলা হয়, আসামিরা অভিন্ন উদ্দেশ্যে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের ছোট বড় করে দেখার সুযোগ নেই। সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসাইন সায়মন ও আরাফাত রহমান সিয়াম আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসেবে সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে, সেজন্য উক্ত পাঁচ আসামির একই সাজা প্রদান করা হবে বাঞ্ছনীয়। অভিজিৎ রায় হত্যায় অংশগ্রহণকারী অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে এবং বিজ্ঞান মনস্ক মুক্তমনা লেখকরা স্বাধীনভাবে লিখতে এবং মতামত প্রকাশ করতে সাহস পাবে না। কাজেই উক্ত আসামিরা সহানুভূতি পেতে পারে না।
তাই ওই পাঁচ আসামিকে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। তাছাড়া ফেসবুকে লেখালেখির মাধ্যমে অভিন্ন উদ্দেশ্যে সহায়তা করা ও অভিজিতের ছবি ফেসবুকে দিয়ে চিনিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে সহায়তার অভিযোগে আদালত শফিউর রহমান ফারাবীকে একই আইনের ৬(২)(আ) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গ্রেফতার চার আসামিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুরান ঢাকার আদালতে আনা হয়। বেলা ১২টা বাজার কয়েক মিনিট আগে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের অষ্টম তলায় সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালে তাদের আনা হয়। পুলিশ বেষ্টিত কোর্ট হাজতে আসামি ফারাবী শুধু এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকেন। আবু সিদ্দিক সোহেলসহ দুই আসামি রায় ঘোষণার আগে খুব হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। তবে রায় ঘোষণার পর যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ফারাবীকে কিছুটা উৎফুল্ল দেখা গেলেও বাকিরা চুপসে যান।
বেলা ১২টা ৮ মিনিটের দিকে বিচারক আসন গ্রহণ করেন। বেলা সোয়া ১২টার দিকে রায়ের সংক্ষিপ্ত সারাংশ পড়া শেষে দণ্ড ঘোষণা করেন বিচারক। রায় ঘোষণার সময় বেশকিছু সংবাদকর্মী, আইনজীবী ও পুলিশ সদস্য এজলাসে থাকলেও কোনো দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক বা নিহত অভিজিতের পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। রায় ঘোষণার পর এজলাস কক্ষে থাকা সংবাদকর্মী ও আইনজীবীরা বেরিয়ে যান। তার কিছুক্ষণ পর পুলিশ একে একে চার আসামিকে বের করে নিয়ে যায়। আসামিদের এজলাসে তোলার সময় বাইরে জুতা খুলে রেখে দেওয়া হয়।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। তবে সব আসামির একই দণ্ড হলে খুশি হতাম। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ফারাবীর দণ্ড বাড়ানোর বিষয়ে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
অপরদিকে আসামিপক্ষ বলছে, তারা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম বলেন, এই আসামিদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই। তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ আসামিদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেননি। এই আসামিরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১
কেআই/এমজেএফ