ঢাকা: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট স্থাপনের জন্য গাছ কাটা বন্ধে রিটের শুনানি চার সপ্তাহের জন্য মুলতবি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ বিষয়ে আদালত অবমাননার আবেদনের ওপর শুনানি দুই সপ্তাহের জন্য মুলতবি (স্ট্যান্ডওভার) করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২০ মে) উচ্চ আদালতের পৃথক বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালত অবমাননার আবেদন
গত ৯ মে সরকারের এক সচিবসহ তিন কর্মকর্তার নামে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার এ আবেদনটি দায়ের করা হয়েছিল। একইসঙ্গে গাছ কাটা বন্ধ করে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম স্থগিত এবং যে নকশার ভিত্তিতে এ কার্যক্রম করা হচ্ছে তা আদালতে দাখিল করার নির্দেশনা চাওয়া হয়।
গত ১১ মে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির জন্য ওঠে।
ওইদিন আদালতের নির্দেশনার বাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট স্থাপনের জন্য গাছ কাটার বিষয়ে আদালত অবমাননার আবেদনের ওপর আগামী ২০ মে শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছিল। আর এই সময়ে যেন গাছ কাটা না হয় সেটি নিশ্চিত করতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলা হয়েছে।
সে অনুসারে বৃহস্পতিবার মামলাটি কার্যতালিকায় ওঠে।
আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুসারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। মন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা প্রসঙ্গে সবাইকে নিয়ে বৈঠক করবেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। এক মাস সময় দেন। এক মাস পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
সময়ে আপত্তি নেই জানিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলকে নিশ্চিত করতে হবে এ সময়ে যেন কোনো গাছ কাটা না হয়। তখন আদালত বলেন, যদি গাছ কাটে তাহলে ওইদিনই আপনি মেনশন (আবেদন) করবেন। এরপর আদালত শুনানি দুই সপ্তাহের জন্য স্ট্যান্ডওভার রাখেন।
আদালতে আবেদনের আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. শামিম আখতার এবং চিফ অর্কিটেক্ট অব বাংলাদেশ মীর মনজুর রহমানকে ই-মেইল যোগে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
নোটিশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা বন্ধ করে রেস্টুরেন্ট/দোকান স্থাপনের কার্যক্রম বাতিল করার জন্য বলা হয়েছে, অন্যথায় আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন মনজিল মোরসেদ।
নোটিশ দেওয়ার পর তিনি জানিয়েছিলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালে একটি রিট পিটিশন দায়ের করলে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে আদেশে দেন। আদেশে আদালত এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিম্নলিখিত স্থানগুলো চিহ্নিত করা হলো।
এক. ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণের স্থান।
দুই. ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণের স্থান।
তিন. ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান।
চার. ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান।
পাঁচ. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থান।
ছয়. ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান।
সাত. ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থান এবং স্মৃতিফলক/জয় স্থাপনা ও সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিদ্যমান সব ধরনের স্থাপনা অপসারণ করে কমিটির চিহ্নিত স্থানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সংরক্ষণকরণ, তবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগের কোনো স্থাপনা এবং বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত স্মারক, ভাস্কর্য, স্মৃতিফলক বা জয় এই আদেশের আওতা বহির্ভূত হবে। অন্য সব স্থাপনা ব্যতিক্রমহীনভাবে অবিলম্বে অপসারণ করাসহ কয়েকটি নির্দেশনা দেন।
আদালতের রায় উপেক্ষা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ব্যবসায়িক স্বার্থে রেস্টুরেন্ট/দোকান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। যা রায়ের সম্পূর্ণ পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেন মনজিল মোরসেদ।
গাছ কাটা বন্ধে রিট
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল নকশার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ স্থাপনা উচ্ছেদ, উদ্যান সংরক্ষণ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই উদ্যানকে মূলরূপে রাখার নির্দেশনা চেয়ে ৯ মে হাইকোর্টে পরিবেশবাদী ছয়টি সংগঠনের পক্ষে ও একজন ব্যক্তি রিট করেন।
বৃহস্পতিবার রিটটি শুনানির জন্য বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে ওঠে।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। আদলত রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে চার সপ্তাহ শুনানি মুলতবি করেন।
রিট আবেদনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের (তৃতীয় প্রকল্প) নামে পুরাতন ও ঐতিহাসিক গাছ কেটে প্রকল্প নির্মাণ কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, মূল নকশার বাইরে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, এরইমধ্যে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তা কেন অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ঢাকা মহানগরের মাস্টারপ্ল্যানের যেভাবে রয়েছে সেভাবে উদ্যান সংরক্ষণ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না সেই মর্মে রুল জারির আবেদন করা হয়েছে।
একইসঙ্গে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য গাছ কাটা বন্ধ রাখার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যেসব গাছ কাটা হয়েছে তার পরিবর্তে তিন গুণ গাছ লাগানোর নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
রিট আবেদনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান বন সংরক্ষক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে বিবাদী করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফরমস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), নিজেরা করি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পক্ষে এবং স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন এ রিট করেন।
এর আগে ৬ মে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উদ্যানের শতবর্ষী ও বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের আশ্রয়স্থল গাছগুলো না কাটতে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২১
ইএস/এমজেএফ