ঢাকা: অস্ত্র মামলায় বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।
রায়ের পর জি কে শামীমের স্ত্রী শামীমা সুলতানা বলেন, জানতাম সাজা হবে।
এদিকে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন জিকে শামীম। রায় শেষে কড়া পুলিশি প্রহরায় বেরিয়ে যাওয়ার সময় জিকে শামীম সাংবাদিকদের বলেন, আমি নির্দোষ। আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।
রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলাম এই রায় দেন।
দুপুর একটার পাঁচ মিনিট আগে আসামিদের এজলাসে হাজির করা হয়।
এ সময় তাদের লোহার খাচায় তৈরি কাঠগড়ায় উঠানো হয়। দুপুর একটার পর পর আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীতে পরিপূর্ণ এজলাসে উঠেন বিচারক।
এ সময় দুই মিনিটে সাজা সংক্রান্ত রায়ের অপারেটিং পার্ট তিনি পাঠ করে শুনান।
রায়ে ৮ আসামির মধ্যে জিকে শামীম, দেহরক্ষী মো. জাহিদুল ইসালাম, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. কামাল হোসেন, মো. সামসাদ হোসেন, মো. দেলোয়ার হোসেন ও মো. মুরাদ হোসেন ১৯৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯ (ই) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে একই আইনের ২১/২৩ ধারার অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।
এছাড়া অপর আসামি মো. আমিনুল ইসলামকে অস্ত্র আইনের ১৯(এ)/১৯(এফ) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।
রায় ঘোষণা শেষে আট আসামিকে সাজা পরোয়ানা মূলে কারাগারে পাঠানো হয়। আসামিদের কাছে জব্দকৃত আলামত একটি পিস্তল, ৪৭ রাউন্ড গুলি, সাতটি শর্টগান, ৭৩টি কার্তুজ ও ৮টি ফোন রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের আদেশ দেন আদালত।
রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম বলেন, জি কে শামীমের অস্ত্রের লাইসেন্স আছে। সেই মর্মে অস্ত্রের মালিকানা সংক্রান্ত প্রমাণপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করেছেন। অথচ তাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। বাসা থেকে জব্দকৃত অস্ত্রের মাধ্যমে কীভাবে ভয়ভীতি দেখানো হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। তাছাড়া কোনো সাক্ষীও আদালতে ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
তিনি আরও বলেন, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে ১৯(এ) ধারায় সাজা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে ১৯(ই) ধারায়, কিন্তু সাজা দেওয়া হয়েছে ১৯(এ) ধারায়। এই চার্জ কখন পরিবর্তন হলো তা আমরা জানি না। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি দেখে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সালাহউদ্দিন হাওলাদার বলেন, যেই ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে সেই ধারাতেই রায় হয়েছে। ১৯(ই) ধারায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চার্জগঠন হয়েছে। সেই ধারাতেই সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। এখানে চার্জ পরিবর্তন হয়নি, এ নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নাই।
একই সঙ্গে রায়ে সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী।
গত ২৮ আগস্ট এই মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ওইদিনই আদালত রায়ের জন্য ২৫ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।
২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি একই আদালত আসামিদের চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বিচারকালে মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
এই মামলায় ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে র্যাব-১ এর উপ-পরিদর্শক শেখর চন্দ্র মল্লিক।
মামলার চার্জশিটে বলা হয়, জামালপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়েছে মর্মে আসামি আমিনুল ইসলাম কাগজপত্র দেখালেও তা যাচাইয়ের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই তার অস্ত্রটি অবৈধ। তিনি ওই অবৈধ অস্ত্রের নকল কাগজপত্র নিয়ে ২০১৭ সালে প্রথমে এস এম বিল্ডার্স কোম্পানিতে যোগদান করেন। পরে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি আসামি জিকে শামীমের দেহরক্ষী হিসেবে যোগদান করে কাজ করে আসছিলেন।
তিনি মূলত অবৈধ অস্ত্রটি ৭০ হাজার টাকায় ক্রয় করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করেন। তাই তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের ১৯(ক)/২১/২৩ ধারার অভিযোগসহ প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৮ ধারার অভিযোগ এনে পৃথক একটি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
এছাড়া অন্য আসামিরা নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও তারা শর্ত ভঙ্গ করে অস্ত্র প্রকাশ্যে বহন, প্রদর্শন ও ব্যবহার করে লোকজনের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও জুয়ার ব্যবসা করে স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন করেছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের ১৯(ঙ)/২১/২৩ ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতনে শামীমের বাড়ি ও অফিসে র্যাব অভিযান চালিয়ে আটটি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলি, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর এবং নগদ প্রায় এক কোটি ৮১ লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা এবং মদ জব্দ করে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা করা হয়।
আরও পড়ুন>>জিকে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২
কেআই/এএটি