ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

আমাদের একজনই নন্দিনী

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১০

সংস্কৃতিচর্চার অলিতে-গলিতে তার বিচরণ। অভিনয়-নাচ-মডেলিং-উপস্থাপনা, সব জায়গায় ছড়িয়েছেন প্রতিভার দ্যুতি।

চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, মঞ্চ সর্বত্রই তার ছন্দোময় বিচরণ। সময়ের বাঁকে বাঁকে এমন মেধাবী শিল্পী খুব বেশি আসেন না। আমাদের পারফর্মিং মিডিয়ার নন্দিত তারকা অপি করিমকে নিয়ে  এবার বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর-এর বিশেষ আয়োজন।

এমন ভুবন ভোলানো মধুর হাসি নন্দিনীর মুখেই মানায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী নাটক ‘রক্তকরবী’র সেই নন্দিনী। যপুরীর নিরেট রাজ্যে একা নন্দিনীই তো ছড়িয়ে দেয় হাসি-আনন্দের ফাল্গুধারা। আমাদের শোবিজের নন্দিত অভিনেত্রী অপি করিমের প্রিয় চরিত্র নন্দিনী। যারা মঞ্চনাটকের খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনায় ‘রক্তকরবী’ নাটকে অপি করিম নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করে মন মাতিয়েছেন হাজার দর্শকের। রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী বাইশে শ্রাবণকে সামনে রেখে নাগরিক আবারও মঞ্চে নিয়মিত প্রদর্শন করতে চলেছে ‘রক্তকরবী’ নাটকটি। অপি করিমের কাছে এ নাটকে অভিনয়ের অনুভূতির কথা জানার আগে আসুন চোখ রাখি তার শিল্পীজীবনের নানা বাঁকে।

বয়স তখন কত অপির? বড়জোর আড়াই কি তিন। বিটিভিতে প্রচারিত বেগম মমতাজ হোসেনের লেখা জনপ্রিয় ধারাবহিক নাটক ‘সকালসন্ধ্যা’য় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে অপি করিমের শিল্পীজীবন শুরু। কাস ফাইভে পড়া পর্যন্ত শিশুশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেন। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়েন নাচ নিয়ে । নাচের শিক ছিলেন শিবলী মোহাম্মদ। নাচ শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেজ প্রোগ্রামে নৃত্য পরিবেশন করা শুরু করেন এসএসসি পাশের আগেই। ১৯৯৮ সাল থেকে নতুন করে আবার অভিনয় শুরু করেন। বড় হয়ে করা প্রথম নাটকটির নাম ছিল  ‘পেছনে সবুজগ্রাম’। এ নাটকে আজিজুল হাকিমের বিপরীতে অপি করিম অভিনয় করেন। জিনাত হাকিমের অনুপ্রেরণা তাকে অভিনয়ে নিয়ে আসে। এ বছরই অপি এইচএসসি শেষ করে বুয়েটে ভর্তি হন।

মিডিয়ায় অপি করিমের পথ চলা মসৃণ করে দেয় ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত লাক্স-আনন্দধারা মিস ফটোজনিক প্রতিযোগিতা। মিস ফটোজনিক খেতাববিজয়ী লাক্স তারকা অপি করিমের কাছে একের পর এক আসতে থাকে অভিনয়ের প্রস্তাব। শুরু থেকেই তিনি সিলেক্টিভ নীতি গ্রহণ করেন। নিজের অভিনয়মতার প্রমাণ রাখেন তেপান্তরের রূপকথা, ওঙ্কার, চড়–ইভাতি, ভয়, শুকনো ফুল রঙিন ফুল প্রভৃতি নাটকে। অপির মতে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ধারাবাহিক নাটক ‘৫১বর্তী’ তাকে এনে দেয় আলাদা পরিচিতি। বাঙালিয়ানার সবটাই ছিল শিউলি চরিত্রে। ঘর-সংসার করা, দেবর-ননদদের টেককেয়ার করা, তাদের সমস্যার কথা শোনা আর স্বামীর কাছে বড় বড় চিঠি লেখাই ছিল শিউলির প্রধান কাজ। এরকম একটি কোমল মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে তৃপ্তি পেয়েছিলেন অপি করিম। টিভিনাটকে এটাকেই নিজের করা প্রিয় চরিত্র মনে করেন। যদিও বাস্তবে তিনি শিউলির মতো নন মোটেও। এখন পর্যন্ত অপি একটাই ছবিতে অভিনয় করেছেন, ছবিটি হলো ‘ব্যাচেলর’। তারপর চলচ্চিত্রে কাজ করার বহু প্রস্তাব তিনি পেয়েছেন, কিন্তু মনমতো চরিত্র না পাওয়ায় কিংবা অন্য কোনো কারণে ব্যাটে-বলে না মেলায় কাজ করা হয়নি। তার মানে এই নয় যে, ভবিষ্যতে আর কখনো তাকে সিনেমায় দেখা যাবে না।

লাক্সসহ বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে অপি করিম মডেলিং করেছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে মডেল হয়েছেন বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের। কিন্তু এ মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের েেত্র তিনি সবচেয়ে চুজি। অনেক বাছবিচারের পর যদি সবকিছু মিলে যায় তবেই মডেলিং করেন। এ কারণে মডেলিংয়ে আজকাল তাকে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। শখের বশে দু-একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলেও নিয়মিত এই ভূমিকায় প্রথম দেখা যায় বাংলাভিশনে প্রচারিত ‘আমার আমি’ অনুষ্ঠানে। অপি করিমের সপ্রতিভ উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে একুশে টিভির ‘আয়নাঘর’ অনুষ্ঠানটিরও উপস্থাপনায় তাকে দেখা যায়। যদিও অপি মনে করেন, উপস্থাপনার কাজটি তার নয়। তিনি যেটা করেছেন সেটা হলো সহকর্মী শিল্পীদের সঙ্গে বসে কিছুণ আড্ডা দেওয়া। এমনিতে অপি আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। বুয়েটে পড়াশোনার সময় সহপাঠীদের সবচেয়ে আড্ডাবাজ গ্র“পটির সদস্য ছিলেন। শিল্পচর্চায় অপি করিমের সবচেয়ে প্রিয় শাখা হলো নাচ। নৃত্যশিল্পী হিসেবে যদিও অপি করিমের পরিচিতি তেমন নয়, তবে কেউ যদি তার নাচ নিয়ে কথা বলতে আসে; সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত হন সে সময়। নিজেকে নাচের মেয়ে ভাবতে খুব পছন্দ করেন। তবে টিভি প্রোগ্রামে নাচার চেয়ে মঞ্চে নাচতেই বেশি ভালো লাগে তার।

বুয়েট থেকে আর্কিটেকচার পাস করে অপি কিছুদিন শিকতাও করেছেন। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর অপি করিম টুপ করে বসে পড়েন বিয়ের পিঁড়িতে। বিয়ের আগে একাধিক সাক্ষৎকারে বলেছেন, মিডিয়ার কাউকে বিয়ে করবো না। দেখা গেলো সেটাই সত্য। অপির স্বামী ড. আশির আহমেদ জাপানের কিউসু বিশ্বিবিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। বছরের একটা সময় স্বামীর সঙ্গে তিনি জাপান কাটান। এরই মাঝে স্থাপত্যবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার জন্য অপি জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। কাজেই আগামী দিনগুলো তাকে বাংলাদেশ-জাপান-জার্মানি করেই কাটাতে হবে। দেশে যেটুকু সময় থাকছেন, তার সিংহভাগই তিনি মিডিয়াতে দিচ্ছেন।

সামনে ঈদ কাজেই অন্য সব তারকার মতোই অপি করিম কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। এ মুহূর্তে কী নিয়ে ব্যস্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঈদের নাটকের শুটিং নিয়ে। তার ওপর আছে ‘মার্কস অলরাউন্ডার’-এর কাজ। সব মিলিয়ে বলা যায় দৌড়ের ওপর আছি।

ঈদের কাজ কী কী করলেন? জানালেন, ঈদের পাঁচটা নাটকে এবার অভিনয় করছি। এর মধ্যে আছে নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল, চয়নিকা চৌধুরী আর সাগর জাহানের নাটক। আরেকটার ব্যাপারে কথাবার্তা  হয়েছে, এ মুহূর্তে নির্মাতার নাম না বলাই ভালো।

আপনি বাংলাদেশের শোবিজের একজন ঝলমলে তারকা, আপনার সাফল্যের পেছনে কী কী বিষয় কাজ করেছে বলে মনে করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে একটু ভেবে নিয়ে অপি বললেন, আসলে সাফল্যের জন্য সবার আগে প্রয়োজন নিজের চেষ্টা ও নিষ্ঠা। তারপর লাগে ভাগ্যের সহায়তা। তাছাড়া আমি সময় খুব মেনে চলি। সময়ের কাজ সময়মতো করেছি বলেই মিডিয়ায় কাজ করার পরও পড়ালেখাটাও ঠিক রাখতে পেরেছি। পাশাপাশি আমি মানুষকে সম্মান করি।   সবসময় বিশ্বাস করি, তুমি যদি কাউকে সম্মান দাও, তাহলে তুমিও পাবে। তারপরও আমার কথায় কিংবা ব্যবহারে কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন সেটা অনিচ্ছাকৃত। আমি কাজের ক্ষেত্রে আমাদের পরিবারের সবার পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি সবসময়। আমার যদি কোনো অর্জন থেকে থাকে তাহলে নিজের যোগ্যতার পাশাপাশি পরিবার অর্থাৎ বাবা-মা-ভাই-বোন সবার সহযোগিতা ছিল বলেই আজকে এই জায়গায় আসতে পেরেছি।

অপি আরো বললেন, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি কারণ শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও আমি এই সহযোগিতা পেয়ে আসছি। আমার স্বামীও মিডিয়ায় কাজ করার ব্যপারে আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন।


নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীই মিডিয়ায় অপি করিমকে আইডল মনে করেন। কিন্তু অপির আইডল কে? বললেন, সত্যি বলতে কি মিডিয়াতে আমার কোনো আইডল নেই। আমার আইডল হলেন আমার এক খালা ডা. শাহীন আরা আলম নিঝু। তিনি সবদিক থেকেই একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তিনি একই সঙ্গে খুব সুন্দরী, শিক্ষিতা, সুগৃহিণী এবং সবসময় তিনি মানুষের সঙ্গে হেসে কথা বলেন। আরেকজন মানুষের পথচলাটা অমার ভালো লাগে । তিনি ফেরদৌসী মজুমদার। উনার মতো নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মানুষই আমার পছন্দ।

প্রতিটি শিল্পীর জীবনই মানুষের ভালোবাসাধন্য। মানুষের প্রতিও শিল্পীর কিছু দায়বদ্ধতা আছে। এ প্রসঙ্গে অপি করিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বড় বড় কথা না বলে আমি কাজ করে দেখিয়ে দেবার পক্ষে আমার কিছু চিন্তা আছে সমাজের জন্য। তা এখনই বলতে চাই না। কোনো কারণে তা করতে না পারলে লোক হাসবে। তারপরও কাজের মাধ্যমে আমরা কিন্তু সমাজে কিছু ম্যাসেজ দেই। ‘শুকনো ফুল রঙিন ফুল’ নাটকে কর্মজীবীদের পড়াশোনার কথা শোনাই। বাস্তব জীবনেও চেষ্টা করি মানুষকে সচেতন করতে। রাস্তায় একটা ফুলবিক্রেতা বাচ্চাকে দেখলে জানতে চাই, সে স্কুলে যায় কিনা। তাকে পড়াশোনা করতে বলি। ওদের কেউ কথা শোনে কেউ শোনে না। একটা দৈনিকের মাদকবিরোধী সংগঠনের আমি সক্রিয় কর্মী। গল্পের ছলে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করি, মাদক থেকে দূরে থাকুন। আমি মনে করি ১০ হাজার মানুষের মধ্য থেকে আমাকে পছন্দ করে যদি একজন মানুষও মাদক ছেড়ে দেয়, তাতেই আমি সার্থক।

সবশেষে আবার ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী প্রসঙ্গ। এই ধ্রুপদী চরিত্রে অভিনয়ের অনুভূতির কথা জানিয়ে অপি বললেন, যখন থেকে আমি নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় শুরু করি, তখন থেকেই আমি যেন নাটকের বাইরেও একজন নন্দিনী হয়ে গেছি। নিজের ভিতর আমি নন্দিনীর প্রভাব ভীষণভাবে টের পাই। যদিও আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের পে নন্দিনী গুণাবলি অর্জন করা আকাশকুসুম ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়। মঞ্চে নিয়মিত ‘রক্তকরবী’ নাটকটি প্রদর্শিত না হাওয়ার জন্য অপি করিম নিজেকে দায়ী মনে করেন। কারণ জাপান-জার্মানি ছোটাছুটি করার কারণে মাঝখানে তার পে মহড়ায় বা প্রদর্শনীতে সময় দেয়া সম্ভব হয়নি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ও অপি করিমের বিকল্প হিসেবে আরেকটা নন্দিনী তৈরি করতে পারেনি। সত্যি বলতে কি, সবাই তো নন্দিনী হয়ে উঠতে পারে না। আমাদের এই সময়ে নন্দিনী হয়ে ওঠার মতো অভিনেত্রী একজনই আছেন, তিনি অপি করিম।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৩৫০, জুলাই ৩১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।