শিবু কুমার শীল এই সময়ের তরুণ নাট্যকার ও নির্মাতা। একই সঙ্গে তিনি একজন অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী।
চারুকলায় পড়াশোনার সময় সমমনা তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন, কিছু করা দরকার। মেসবাউর রহমান সুমন, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল আর শিবু কুমার শীল মিলে গড়ে তুললেন একটা গানের দল, নাম মেঘদল। দলের হয়ে নিজেরাই গান লিখেন, নিজেরাই সুর দেন আর নিজেরাই গলা মিলিয়ে গেয়ে যান গান। কিন্তু যাদের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া তাদের শুধু শিল্পের একটা শাখায় নিজেদের সীমিত রাখলে চলবে কেন?
মেঘদলের তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন টিভির জন্য নাটক বানাবেন। শিবুর ওপর দায়িত্ব পড়ে স্ক্রিপ্ট লেখার। সুমন আর উজ্জ্বল পরিচালনার প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। স্ক্রিপ্ট রেডি... অতঃপর তাদের টনক নড়ল, নাটক বানাবেন টাকা কই? তাই দরকার প্রোডিওসার। স্ক্রিপ্ট নিয়ে এর কাছে যাওয়া, তার কাছে যাওয়া। কিন্তু প্রোডিওসার আর খুঁজে পান না। প্রায় দেড় বছর ঘোরাঘুরির পর অবশেষে একজনের দয়া হলো। সংবিধিবদ্ধ নানা সতর্কতা আর শর্ত সাপেক্ষে অবশেষে তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলো। শিবু কুমার শীলের লেখা নাটক ‘আমি অরুপার কাছে যাবো’ নাটকটি প্রচারিত হয়েছিল ২০০৩ সালে চ্যানেল আইতে।
অভিনেতা শিবু কুমার শীলের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় হয় এনটিভির ধারাবাহিক নাটক ‘কফি হাউজ’-এর মাধ্যমে। এখানেও মেঘদলের সেই ত্রিরত্ন। শিবু অভিনেতা আর দুই বন্ধু রইলেন চিত্রনাট্য রচনা আর পরিচালনার দায়িত্বে। এরপর নাট্যকার শিবু কুমার শীলের লেখা নাটক ‘দখিনের জানালাটা খোলা আলো আসে আলো ফিরে যায়’ প্রচার হয় আরটিভিতে, পরিচালনায় ছিলেন মেসবাউর রহমান সুমন। ২০০৭ সালের মেরিল-প্রথম আলো অ্যাওয়ার্ডে এ নাটকটি লেখার জন্য শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে নমিনেশন পান।
নাটক রচনার পাশাপাশি শিবু কিছু ডকুমেন্টারি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’ গল্প অবলম্বনে শিবু কুমার শীল নির্মিত ডকুড্রামাটি বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পরিষদের বেস্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। ডকুমেন্টারিটি পরবর্তীকালে চ্যানেল আইতে প্রদর্শিত হয়। ২০০৯ সালে দেশটিভিতে প্রচারিত তার পরিচালনায় প্রথম নাটক ‘অত্রি’। একই বছর শিবু কুমার শীল ‘কেউ নয় শূন্যতা’ নাটকটি রচনার জন্য দ্বিতীয়বারের মতো মেরিল প্রথম আলো নমিনেশন পান।
খ্যাতিমান নির্মাতা তারেক মাসুদ নির্মিত শর্টফিল্ম ‘নরসুন্দর’-এর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন শিবু। বর্তমানে তিনি প্রবাসী ভাস্কর্যশিল্পী নভেরার জীবন অবলম্বনে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের কাজ করছেন। আসছে ঈদে তার লেখা একটি নাটক অন-এয়ারে যাবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘অপরাহ্নের গল্প’ অবলম্বনে শিবুর চিত্রনাট্য রচনায় ‘তিন শরতের গল্প’ নাটকটি পরিচালনায় রয়েছেন অমিতাভ রেজা।
গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী শিবু কুমার শীল বর্তমানে যুক্ত আছেন প্রাচ্যনাটের সঙ্গে। প্রাচ্যনাটের ‘সার্কাস সার্কাস’ ও বিষপাঁচালি’ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। এছাড়া দলের বিভিন্ন প্রযোজনায় সঙ্গীত পরিকল্পনার কাজে অংশ নিয়েছেন। নাট্যচর্চায় তার হাতেখড়ি হয়েছিল মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। এই দলের ‘ঘুম নেই’ ও ‘আয়না’ নামের দুটো প্রযোজনায় অভিনয়ও করেছিলেন।
এতো কিছুর পরও মূল প্লাটফর্ম ‘মেঘদল’-এর কাজেও শিবু কুমার শীল নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। ২০০৪ সালে মেঘদলের মিক্সড অ্যালবাম ‘নিয়ন আলোয় স্বাগতম’ বেরিয়েছিল। বর্তমানে চলছে মেঘদলের প্রথম মৌলিক গানের অ্যালবাম ‘বাঘবন্দী’র কাজ। অ্যালবামের অন্যতম গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শিবু সেখানেও নিয়মিত সময় দিচ্ছেন।
অমর চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় হলেন শিবু কুমার শীলের আইডল। সত্যজিৎ একই সঙ্গে সাহিত্য রচনা করেছেন, ছবি এঁকেছেন, গান লিখেছেন, চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। একজন মানুষ যে একসঙ্গে অনেক কিছুর মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারেন সত্যজিৎ রায় সেই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তার দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে চলতে চান শিবু। গান করা, ছবি আঁকা, থিয়েটার চর্চা, ফিকশন আর নন-ফিকশন রচনা ও নির্মাণ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে চান। বড় চলচ্চিত্রকার হওয়ার স্বপ্ন তার এগিয়ে চলার প্রেরণা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯৫৬, আগস্ট ০১, ২০১০