সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই ভালো কোনো কাজ করার পর এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করেন। আমাদের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা মৌসুমী এখন এমনই প্রশান্তির মধ্যে আছেন।
বছর দেড়েক আগে মৌসুমী চলচ্চিত্রে তার ১৫ বছরের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে হঠাৎ করেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, অভিনয় আর নয়। হাতের ছবিগুলো শেষ করে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিবেন। কিন্তু চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবার অনুরোধে নিজের সে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। শিল্পী সংকটের এই দুর্দিনে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। এ বিষয়ে বাংলানিউজকে মৌসুমী বলেন, প্রত্যেক শিল্পীই তো চান ভালো কাজ করতে, বৈচিত্র্যময় কাজ করতে। টানা ১৫ বছর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর আমার ভিতর এক ধরনের কান্তি ভর করে। যেসব চরিত্রে অভিনয় করছি, সেগুলোকে একঘেয়ে মনে হতে থাকে। তাই এক ধরনের হতাশা নিয়ে ঠিক করেছিলাম, চলচ্চিত্রে আর নয়। কিন্তু এরপরই আসতে থাকে একের পর এক অনুরোধ। ভেবে দেখলাম, চলচ্চিত্র থেকে একদম সরে না গিয়ে আমি তো ভালো ছবিগুলোকে প্রমোট করতে পারি। আমার শ্রদ্ধাভাজন চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্বদের অনুরোধও উপেক্ষা করতে পারিনি। তাই কাজ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। তবে চলচ্চিত্রে আগের মতো আর সময় দেওয়া সম্ভব নয়। তাই কাজ করব বছরে বড়জোর দু-তিনটি ছবিতে। আর যে চরিত্রে অভিনয় করব, চরিত্রটিকেও অবশ্যই ভালো হতে হবে। চাষী নজরুল ইসলামের ‘রঙিন দেবদাস’ আর মোস্তফা কামাল রাজের ‘প্রজাপতি’ সেরকমই ভালো দুটো কাজ। আগামীতেও শুধু এরকম ভালো মানের ছবিতেই কাজ করব। আমার অভিনয় জীবনের দীর্ঘসময়ের অর্জন রক্ষার ব্যাপারে আমি খুবই সচেতন।
চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে ‘রঙিন দেবদাস’ ছবিতে মৌসুমী অভিনয় করছেন চন্দ্রমুখী চরিত্রে। এ ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে বলেন, ছবিতে আমার অংশের কাজ সামান্য বাকি, বেশির ভাগ অংশের শুটিংই শেষ। ছবিতে আমার করা ‘চন্দ্রমুখী’ চরিত্রটি একটি কালজয়ী চরিত্র। আমার কাছে তো বরাবরই মনে হয় পার্বতী থেকেও চন্দ্রমুখী চরিত্রটি অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। পার্বতী তো দেবদাসের ভালোবাসা পেয়েছে, কিন্তু চন্দ্রমুখী তাও পায়নি। সে আজীবন শুধু ভালোবেসেই গেছে। এ ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ বার বার আসে না, তাই চেষ্টা করেছি সামর্থ্যরে সবটুকু ঢেলে কাজটা করতে। তবে একটা ছবির সাফল্য কখনও একজনের ওপর নির্ভর করে না। এজন্য দরকার সব শিল্পীর প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা।
মুহম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘প্রজাপতি’ ছবিতে মৌসুমী অভিনয় করেছেন দুই অভিনেতার বিপরীতে। এ প্রসঙ্গে মৌসুমী বলেন, ছবিটি সুন্দর একটা পারিবারিক জীবনের গল্প নিয়ে। স্বামী-স্ত্রীর সংসারে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে যে জটিলতা তৈরি হয় তা নিয়েই কাহিনী। এতে আমি আর মোশাররফ করিম করছি স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা, আর তৃতীয় পক্ষ হচ্ছেন জাহিদ হাসান। গল্পটা সাদামাটা হলেও তার উপস্থাপনায় নতুনত্ব আছে। সংলাপ চমৎকার। গানগুলো অসাধারণ।
এ মুহূর্তে মৌসুমী অভিনীত মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ছবির মধ্যে আছে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দুই পুরুষ’ ও উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘মায়ের মতো বোন’। আরও অভিনয় করছেন মাসুম আজিজ পরিচালিত ‘লীলাখেলা’, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামূল পরিচালিত ‘এক কাপ চা’ ছবিতে।
শুধু অভিনয়ই নয়, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন মৌসুমী। তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’। মুশফিকুর রহমান গুলজারের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন কাজী নজরুলের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘মেহের নিগার’ চলচ্চিত্র। মৌসুমী জানান, এ মুহূর্তে নতুন কোনও ছবি পরিচালনার পরিকল্পনা তার নেই । তিনি স্ক্রিপ্ট খুঁজছেন। ভালো স্ক্রিপ্ট পেলেই পরিচালনার কথা ভাববেন।
এই সময়ের চলচ্চিত্রের সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে মৌসুমী বলেন, এই ঈদে নাকি মাত্র ৪টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। অথচ আগে প্রতি ঈদে কমপক্ষে ৮-১০টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবি মুক্তির হার কমে যাওয়ায় আমি শঙ্কিত। আরও শঙ্কিত সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায়। সিনেমা হল যদি না থাকে, তাহলে ছবি কোথায় দেখানো হবে। সরকার ছবি নির্মাণের জন্য অনুদান দিচ্ছে। আমার মনে হয়ে সিনেমা হলগুলো আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি প্রয়োজনে র্ভতুকি দিয়ে হলেও সিনেমা হলগুলো টিকিয়ে রাখার প্রতি সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
বড়পর্দার অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীই মনে করেন, ছোটপর্দায় কাজ করলে চলচ্চিত্রে শিল্পীর কদর কমে যায়। এ কথা ভুল প্রমাণ করেছেন মৌসুমী। নিয়মিতই তিনি টিভিনাটকে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, অভিনয়ের বিভিন্ন মাধ্যম আছে। একজন অভিনেত্রীর সব মাধ্যমে কাজ করা উচিত। টিভি নাটকে কাজ করলে চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়, এ কথা আমি মানতে নারাজ। একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর প্রথম থাকতে হবে অভিনয় ক্ষমতা আর কাজের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ। মাধ্যম যেটিই হোক মেধা বা প্রতিভা থাকলে তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। তবে, অভিনেতা-অভিনেত্রীকে মাধ্যমটির ভাষা বুঝে কাজ করতে হবে।
মৌসুমীকে এই ঈদে দেখে গেছে রেদোয়ান রনী পরিচালিত ‘অপরাজিতা’ নাটকে। সম্প্রতি মৌসুমী অভিনয় করেছেন ফারিয়া হোসেন রচিত ও আরিফ খান পরিচালিত মেগাসিরিয়াল ‘চাঁদফুল অমাবস্যা’তে। মজার ব্যাপার, ধারাবাহিকটিতে তিনি অভিনয় করছেন চিত্রনায়িকা মৌসুমীর চরিত্রেই। আগামী মাস থেকে ১০৪ পর্বের এ ধারাবাহিক নাটকটি প্রচার হবে এনটিভিতে।
এই ঈদে মৌসুমী একেবারেই নতুন এক পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ফ্যাশন ডিজাইনার মৌসুমীর সঙ্গে ঈদের আগেই ভক্তদের পরিচয় হয়েছে। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার নিজের পোশাক বেশির ভাগ সময় আমি নিজেই ডিজাইন করে থাকি। সেই বিদ্যে নিয়ে ভাবলাম, দেখা যাক একটু চেষ্টা করে। এভাবেই আসা। মৌসুমীর ডিজাইন করা পোশাক পাওয়া যাচ্ছে বসুন্ধরা সিটিতে শিল্পীর নিজস্ব ‘লিভাইস’ শোরুমে।
এতভাবে নিজেকে ছড়িয়ে দেবার পরও মৌসুমী সংসারের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন নিয়মিত। স্বামী ওমর সানী আর দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিনই আলাদা কিছুটা সময় হাতে রাখেন। কীভাবে এত কিছু ঠিক রেখেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে মিষ্টি হেসে বললেন, যিনি রাঁধতে জানেন তিনি চুলও বাঁধতেও জানেন।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮২৫, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১০