যদিও তিনি মীন রাশির জাতিকা, তবু তাকে ‘তুলা রাশির মেয়ে’ বললে ভুল বলা হবে না। কারণ ‘তুলা রাশি’ শীর্ষক একটি গানই প্রথম তাকে এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি।
আমাদের গানের ভুবনে শাকিলা জাফর পথ চলছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ পথচলায় তিনি গেয়েছেন শ্রোতাপ্রিয় অসংখ্য গান। অডিও সেক্টর আর প্লেব্যাকের পাশাপাশি স্টেজ প্রোগ্রামেও এতদিন ধরে রেখেছেন জনপ্রিয়তা। নন্দিত গায়িকা শাকিলা জাফরের ৩০ বছরে গাওয়া জনপ্রিয় গান থেকে বাছাই করা গান নিয়ে সম্প্রতি একটি গোল্ডেন সিডি প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গানগুলো নতুন সঙ্গীতায়োজনে গাইবেন শাকিলা জাফর। এছাড়া একটি দ্বৈত অ্যালবামের জন্য সম্প্রতি তিনি তপন চৌধুরীর সঙ্গে কিছু গান রেকর্ডিং করেছেন।
গানের পাখি শাকিলা জাফর তার দীর্ঘ পথচলায় জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেন নি, বরং জনপ্রিয়তাই ছুটেছে তার পেছনে। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে কখনো আপস করেননি। প্রলোভনের কাছে মাথা নত না করে একাধিকবার তাকে নকল ও বিকৃত গান গাইতে অস্বীকৃতি জানাতে দেখা গেছে। আজেবাজে গান গাইবেন-ই বা কেনো? ধ্রুপদী গানকে অবলম্বন করে যার পথ চলা শুরু, তাকে আপস করা মোটেও মানায় না। যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই গানের সঙ্গে তার সখ্য। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠিত জাতীয় উচ্চাঙ্গ প্রতিযোগিতায় শাকিলা জাফর প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর নিয়মিত তিনি বেতারে নিয়মিত গান পরিবেশন করা শুরু করেন। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ছাড়া শুরুর দিকে ক্যাসিক ও নজরুল সঙ্গীত গেয়েছেন। পরে আধুনিক গানও গাইতে শুরু করেন।
আজকের মতো এতো টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি তখন ছিল না। বিটিভিই ছিল একমাত্র ভরসা। বিটিভিতে নবীন শিল্পীদের অংশগ্রহণে একটি গানের অনুষ্ঠানে ‘তুলা রাশির মেয়ে...’ গানটি গেয়ে তিনি আলোচনায় উঠে আসেন। ১৯৮৩ সালে প্রয়াত ফজলে লোহানীর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’-এ গানটি পরিবেশন করার পর শাকিলা জাফরের কেবলই এগিয়ে চলা। একের পর এক অডিও অ্যালবাম, দেশ ও দেশের বাইরে বছরজুড়ে স্টেজ শো, নিয়মিত টিভি প্রোগ্রাম, সিনেমার প্লেব্যাক সবখানেই শাকিলা জাফর উজ্জ্বল-উচ্ছল।
নিজের দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে শাকিলা জাফর বললেন, নিজেকে মূল্যায়ন করা কঠিন। এ কাজটি করবেন শ্রোতা-দর্শক আর সঙ্গীতপ্রিয় মানুষেরা। আমি চর্চা আর সাধনাটাকে সবসময় বড় মনে করি। এখনো আমি সাধনা বা চর্চার মধ্যে আছি। একজীবনে যা শেষ হবে না। সবসময় ভালো গান গাইতে চেয়েছি। জনপ্রিয় শিল্পী হতেই হবে এমন কোনও চাহিদা আমার কখনো ছিল না। সংখ্যার চেয়ে মানের বিষয়টিই সবসময় আমার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। পথ চলার ত্রিশ বছরে যদি আমি ৫টি ভালো গান গেয়ে থাকি তাতেই আমি সার্থক। শিল্পী তো আজীবন বেঁচে থাকে না, সৃষ্টিই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমার গানের আমি মধ্যেই বেঁচে থাকতে চাই।
বাংলাদেশের অনেক গায়িকাই বিভিন্ন গায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে দ্বৈত গান গেয়েছেন। তবে দ্বৈত গানে শাকিলা জাফরই সবচেয়ে সফল শিল্পী। তিনি যখন যার সঙ্গে গান গেয়েছেন, মানিয়ে গেছেন ভীষণভাবে। প্রথমে গায়ক শুভ্রদেবের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছিল সফল গানের জুটি। তারপর কুমার বিশ্বজিৎ, সুবীর নন্দী, তপন চৌধুরী, নকিব খানের মতো সিনিয়র শিল্পী থেকে শুরু করে হালের আসিফ ও বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গেও গেয়েছেন বহু গান। সম্প্রতি কানাডাপ্রবাসী শিল্পী তপন চৌধুরী দেশে ফেরার পর সুবীর নন্দীর সুরে শাকিলা জাফর কণ্ঠ দিয়েছেন কয়েকটি ডুয়েট গানে। আগামী কোরবানির ঈদে এই অ্যালবামটি বাজারে আসতে পারে। এই ডুয়েট গানের অ্যালবামে তপন চৌধুরী ছাড়াও থাকছে সুবীর নন্দী ও সাদি মোহাম্মদের সঙ্গে গাওয়া শাকিলার গান।
মাঝে সিনেমার প্লে-ব্যাক থেকে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন শাকিলা জাফর। কারণ গানের কথায় অশ্লীলতা আর সুরে নকলের প্রাদুর্ভাব। আজেবাজে লিরিক আর নকল সুর হওয়ায় স্টুডিওতে গিয়েও গান গাইতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বেরিয়ে এসেছেন একাধিকবার। হালে মিষ্টি হাওয়া বইতে শুরু করায় প্লেব্যাকে আবারও ফিরে এসেছেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘রঙিন দেবদাস’ ছবির প্লে-ব্যাকে অংশ নিয়েছেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও ইমন সাহার সুরে জনপ্রিয় শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে একটি দ্বৈতগান গেয়েছেন শাকিলা জাফর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটা সময় আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ছিল প্লে-ব্যাক নির্ভর। আজও পুরনো দিনের ছবির গান শুনলে মানুষ মুগ্ধ হন। কিন্তু মাঝখানে চলচ্চিত্রে ভালো গান হয়নি। তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। এখন সিনেমায় ভালো গান করার চেষ্টা চলছে। আমি সেই চেষ্টায় অংশ নিতে চাই বলেই আবার প্লে-ব্যাক করছি।
শাকিলা জাফরের কাছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব বেশি পরিকল্পনা করে আমি কখনো পথ চলিনি আর চলতে চাইও না। গান নিয়ে আছি, গান নিয়ে থাকতে চাই, ভালো গান করতে চাই। এই হলো আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২৩৫, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১০