ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

সেলিম কাহন

তোফাজ্জল লিটন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১০

গিয়াস উদ্দিন সেলিমের প্রথম ছবি ‘মনপুরা’, , প্রথম লেখা টিভি নাটক ‘পৌনঃপুনিক’, প্রথম পরিচালিত টিভি নাটক ‘বিপ্রতীপ’। তার প্রতিটি প্রথম কাজ যেমন দর্শক মাতিয়েছে, তেমনি অর্জন করেছে সমালোচকদের প্রশংসা।

আবার পুরস্কারও পেয়েছেন দেশে-বিদেশে । এসব শুনে কেউ যদি ভাবেন, সম্রাট নেপোলিয়ানের মতো গিয়াস উদ্দিন সেলিমও এলেন দেখলেন আর জয় করলেন, তবে তার ভাবনাটা হবে ভুল। প্রায় ২৮ বছর ধরে তিনি সংস্কৃতিচর্চার সাথে জড়িত। তার উঠে আসার পেছনেও রয়েছে অনেক চেষ্টা ও শ্রম।

গ্রামের সবুজ মাঠ, পুকুরের টলটলে জল আর মাছরাঙা-ঘুঘুর খেলা দেখে তার শৈশব কাটে ফেনীতে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়মিত তার প্রিয় খেলা ফুটবল-ক্রিকেট খেললেও ১৯৮৩ সাল থেকে করতেন সুবচন থিয়েটার। সেখান থেকেই নাটকের পোকা ঢোকে তার মাথায়।

স্কুল-কলেজের পাঠ ফেনীতে চুকিয়ে ভর্তি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু জায়গার দূরত্ব অনেকটা নির্বাসনের মতো। রাবিতে ১৯৮৭-৮৮ ব্যাচে মার্কেটিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর, একদিন সাহস করে ঢুকে পড়েন নাট্যদল ‘অনুশীলনে’র মহড়া কক্ষে। বড় ভাইদের বললেন, ‘আমারে একটা রোল দেওয়া যায় না ! পরে তারা এই দলে কাজের সুযোগ দিতেই ‘অনুশীলন’ হয়ে উঠে সেলিমের সকাল-সন্ধ্যার ঠিকানা।

এ ঠিকানা ’৯০ সালে মতবিরোধের কারণে ভেঙে যায়। সে বছরের ৩ জুন তার সহপাঠী বন্ধু শাহ আজম শান্তনুসহ কয়েকজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার রাজশাহী’ নামের নতুন থিয়েটার। সে বছরই প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দেন। সেটি ছিল এসএম সোলায়মানের ‘ইংগিত’। যে থিয়েটার গড়েছিলেন সেলিম-শান্তনু তা এখনো আছে বহাল তবিয়তে।

বয়ঃসন্ধিকাল থেকে কবিতা লিখলেও ’৯২ সালে ‘ঠ্যারো’ নামে প্রথম পথনাটক লেখেন ‘বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারে’র জন্য। এখনো সে দলটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ নাটক মঞ্চস্থ করে। তখনই নাট্যরূপ দেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’। নির্দেশনা দেন আহসান হাবিব টিটোর ‘ক্বাহার’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’। নিজ দলের প্রয়োজনেই হয়ে উঠেন নাট্যকার-নির্দেশক।

তিনি সব সময়ই স্বীকার করেন নাটক-চলচ্চিত্রে ‘গিয়াস উদ্দিন সেলিম’ একটি ব্র্যান্ডের নাম হয়ে ওঠার  পেছনে থিয়েটারের  অবদান সীমাহীন। তার কথায় ‘আজকের এ সেলিম হওয়ার পেছনে পুরো অবদানই থিয়েটারের। ’ ঢাকা আসার পর ‘দেশনাটকে’ কাজ করলেও কেন তা নিয়মিত করেননি বা এখন কেন থিয়েটার করছেন না? বললেন, ‘থিয়েটার যদি আমার খাওয়া-পরা জোগাড় করতে পারত তবে থিয়েটারই করতাম আজীবন। ’

’৯৩ সালে পড়াশোনার পাঠ শেষ। এদিকে ঢাকায় মাসুম রেজা এবং সালাউদ্দিন লাভলু তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ।   ঢাকায় আসার পরই সবাই মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘স্ট্রিগ প্লাস’ নামে একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান। তারপর ছুটতে থাকেন কাজের পেছনে।

ঢাকায় আসার পর সহযোগিতা বা মূল্যায়ন কেমন পেলেন? এ প্রশ্নের জবাবে বললেন,‘এই মাঠটা ফাঁকা, এখানে একটু মেধা থাকলে যে কারো পক্ষে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব। ঢাকায় এসে আমি কাজের পেছনে ছুটেছি, মূল্যায়নের পেছনে ছুটিনি। যে কাজের পেছনে ছুটবে তার পেছনে মূল্যায়ন ছুটবেই আর যে মূল্যায়নের পেছনে ছুটবে তার পেছনে কিছুই ছুটবে না। ’

ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায়ও প্রথমে নাট্যকার হিসেবেই ক্যারিয়ার শুরু করেন। ‘দক্ষিণের ঘর’, ‘মাধবী এবং অন্যান্য’, ‘দ্বৈরথ’, ‘স্বপ্নশকট’ তার প্রথম দিককার লেখা নাটক । অধিকাংশ নাটকই প্রচার হয় সে সময়ের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল একুশে টিভিতে। প্রথম টিভি নাটক ‘পৌনঃপুনিক’ পরিচালনা করেন কাওসার চৌধুরী । সব মিলিয়ে তিনি রাতারাতি তারকা নাট্যকারে পরিণত হন।

পরিচালক হিসেবে প্রথম করলেন ‘বিপ্রতীপ’, যা টিনেজারদের নিয়ে দেশের প্রথম নাটক। কোন চিন্তা থেকে এ বয়সীদের নিয়ে কাজ করেছিলেন? ‘ওভাবে কোনও চিন্তা করে কাজটা করি নাই, ফ্যামেলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এ বয়সীদের নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিল বলে করেছিলাম। ’

সমালোচনা বিভাগে ‘মেরিল-প্রথম আলো’ পুরস্কার পেয়েছেন ২০০১, ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে । ‘আধিয়ার’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার হিসেবে পেয়েছেন ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। পেয়েছেন এমন অনেক পুরস্কার।

তার বহুল আলোচিত ছবি ‘মনপুরা’র পর বলা যায় বেশ বিরতিতেই আছেন সেলিম। দু-একটি নাটক ছাড়া তেমন কিছু করেননি। তবে মাথার ভেতর অনেক দিন ধরেই চলেছে নতুন ছবির ভাবনা-চিন্তা। আর ইতিমধ্যে তৃতীয় দফায় শেষ করে এনেছেন নতুন ছবি ‘কাজল রেখা’র চিত্রনাট্য তৈরির কাজ। এখন ব্যস্ত শুটিং লোকেশন খোঁজায় এবং শুটিংয়ের পূর্ব-পরিকল্পনায়। ময়মনসিংহ গীতিকাকে অবলম্বন করলেও বিস্তর গবেষণা করছেন এ ‘কাজল রেখা’ নিয়ে। আর গান সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন সাইদুর রহমান লিপন এবং ইমনকে। এ ছবিতে তিনি তুলে ধরবেন বাংলার ৫০০-৬০০ বছর আগের ইতিহাস। ‘মনপুরা’য়  প্রেম-ভালোবাসা প্রধান হলেও ‘কাজল রেখা’র মধ্য দিয়ে বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হবে। তার কথায় ‘বাঙালি ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে যায়। ইতিহাস মনে করাবে এ ছবি। ’ ছবির বেশ কজন অভিনেতা-অভিনেত্রী ঠিক করলেও এখনই কিছু প্রকাশ করতে চান না তিনি।

আগামী ঈদে তৈরি করছেন দেশ টিভির জন্য টেলিফিল্ম ‘সহোদরা’। মাসুম  রেজার রচনায়  টেলিফিল্মটিতে অভিনয় করছেন তারিন, মুক্তি, স্বাগতা, সুজন প্রমুখ । বিটিভিতে এ পর্যন্ত কোনও কাজ না করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি বরাবরই একটি রাজনৈতিক জায়গা। তাই সেখানে আমি যেতে চাই না। ’ বর্তমানে নাটকের কাজ কম করা প্রসঙ্গে বললেন, ‘এখন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে মানুষ বাংলা নাটক দেখে না; দেখে হিন্দি সিরিয়াল এবং ছবি। মানুষ না দেখলে নির্মাণ করে লাভ কী?

প্রায় দেড় যুগ হলো বিয়ে করেছেনস সেলিম। স্ত্রী নাসরীন আক্তার ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফার। মনপুরার পোশাক পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, কাজল রেখারও তিনিই করছেন। দুই ছেলে সুমগ্ন এবং সুজয় । সুন্দর এ নাম দুটির একটি রেখেছেন তিনি নিজে আর ‘সুমগ্ন’ নামটি রেখেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক ।

মজার ব্যাপার হলো, গিয়াস উদ্দিন সেলিম এতো সব কাজের ভীড়েও একজন শখের খেলোয়াড়। এই বয়সেও তিনি ফুটবল আর ক্রিকেট খেলেন। প্রতি শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে  তাকে ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়।   ১২বছর ধরে চলছে তার এই ক্রীড়াযজ্ঞ। নানা পেশাজীবির সাথে সাধারণ মানুষের মতোই খেলেন তিনি ।

গিয়াস উদ্দিন সেলিমের এমন একজন মানুষ, যার জীবন যাপনে নেই বাড়তি ভারিক্কি, নেই কোন ভাব।   একজন সাধারণ মানুষের মতোই তার দিনযাপন। সংসারের প্রয়োজনে বাজারে ছোটেন। সন্তানদের স্কুলের অভিভাবক সভায় হাজিরা দেন। বন্ধুদের আড্ডায় বাজে বকতেও তার জুড়ি মেলা ভার। তবে কথা যা বলেন, তার সবই সোজাসুজি। আর এ কারণেই গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে পছন্দ করেন এমন মানুষ যেমন অসংখ্য, তেমনি অপছন্দ করেন এমন মানুষও কম নেই।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫১০,  নভেম্বর ০৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।