কলকাতার সুপারস্টার প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়। ফকির লালনের জীবন ও দর্শন নিয়ে খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ ছবিতে প্রধান চরিত্রের অভিনেতা।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশে এর আগে কবে এসেছিলেন? এবার বাংলাদেশে আসার অনুভূতি জানতে চাই?
প্রসেনজিত : আমি বাংলায় কথা বলি। আমি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। বাঙালিকে ভালোবাসি। তাই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষকে আমি আপন বলে মনে করি। রাজনৈতিকভাবে আমি অন্য দেশের মানুষ হলেও ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সবকিছুই আমাদের একরকম। বাংলাদেশে এর আগে এসেছিলাম প্রায় এক যুগ আগে। ‘আমি সেই মেয়ে’ নামে একটি ছবিতে কাজ করেছিলাম। এবার বাংলাদেশে এসেছি অনেকটা ব্যক্তিগত আগ্রহেই। ‘মনের মানুষ’ ছবিটি এ দেশের মানুষ কীভাবে নিয়েছেন, তা দেখার জন্য। বাংলাদেশের দর্শকদের সঙ্গে বসে ছবিটি দেখতে পারায় আমি আনন্দিত। এ দেশের মানুষের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন?
প্রসেনজিত : আসলে খুব অল্প সময় নিয়ে এসেছি। ভালো করে দেখার সুযোগ হয়ে উঠে নি। তবে অনেক হাইরাইজ বিল্ডিং এবার চোখে পড়েছে। আর রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামটাও বোধহয় বেড়েছে। স্টার সিনেপ্লেক্সে ‘মনের মানুষ’ দেখতে যাবার সময় অনেক সময় জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষদের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা আগের মতোই আছে।
বাংলানিউজ : ‘মনের মানুষ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য আপনার প্রস্তুতি কেমন ছিল?
প্রসেনজিত : আমি হয়তো এই জীবনে কোনো পুণ্য করেছিলাম। তাই পরিচালক গৌতম ঘোষ এ ছবিতে লালন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমার কথা ভেবেছিলেন। এটা আমার জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ। লালন সম্পর্কে অন্য পাঁচজন বাঙালি যেমন জানেন, আমিও তেমনই জানতাম। ছবিটি করার আগে লালন সম্পর্কে জানার জন্য কিছু পড়াশোনা করি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসটি একাধিকবার পড়ার পাশাপাশি আরো কিছু বইপত্র পড়ি। ছবির শুটিং শুরুর আগের ৭-৮ মাস আমি চুল-দাড়ি কাটিনি। বাউল সাধকদের সঙ্গে গিয়ে থেকেছি, তাদের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য। তিন মাস আমি মাটিতে ঘুমিয়েছি। নিরামিষ খেয়েছি। এটা কোনো বাহাদুরি নয়। আসলে এসব কোনো বাহাদুরির গল্প নয়। লালনকে নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা থেকেই আমাকে এগুলো করতে হয়েছে। আমি লালন হয়েই ‘মনের মানুষ’ ছবিতে অভিনয় করতে চেয়েছি। আমি তো আসলে কমার্শিয়াল ছবির অভিনেতা। আমি চেয়েছি, ব্যক্তিগত জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যেতে। এ সময় আমি তাই কোনো কমার্শিয়াল ফিল্মে অভিনয় করিনি। কমার্শিয়াল ফিল্ম থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের স্রেফ বলেছি, তোমরা কয়েক মাসের জন্য ভুলে যাও যে প্রসেনজিত নামে কোনো অভিনেতা আছে।
বাংলানিউজ : শুটিং চলার সময় আপনার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রসেনজিত : আমি খুব সাধারণ একজন অভিনেতা। নিজেকে আমি ইমোশনাল অভিনেতা মনে করি। শুটিংয়ের সময় আমার ভেতর সেই ইমোশনটা জাগিয়ে তোলার পুরো কৃতিত্ব আমি পরিচালক গৌতম ঘোষকে দিতে চাই। শুটিংয়ে যাবার আগে বা আগের রাতে আমাকে তিনি লালন সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলতেন, যা আমাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যেত। এক ধরনের ঘোরের মধ্যেই আমি পুরো ছবিটিতে অভিনয় করেছি।
বাংলানিউজ : শুটিং চলাকালীন স্মরণীয় কোনো ঘটনা?
প্রসেনজিত : সত্যি বলতে কী, শুটিংয়ের পুরোটা সময় ছিল আমার জন্য ছিল স্মরণীয়। তারপরও একটা ঘটনার কথা বলি। ছবির একটি আলোচিত দৃশ্য হলো, লালন যখন সেবাদাসীর সঙ্গলাভের জন্য যান। এ অংশের শুটিং হয়েছে আমাদের নর্থবেঙ্গলের এক গভীর জঙ্গলে। ক্যামেরা ওপেন করার পর যখন আমরা শট দেওয়ার জন্য দাঁড়ালাম, অমনি শুনি গুলির শব্দ। ফায়ারিং হচ্ছে। ঘটনা কী ? যা শুনলাম তাতে আমাদের পিলে চমকে যাবার জোগাড়। সেই জঙ্গলে নাকি বন্য হাতি আর বাইসনের উপদ্রব আছে। তাদের তাড়ানোর জন্যই একটানা ফায়ারিং করা হচ্ছে। এই ফায়ারিংয়ের মধ্যেই আমাদের ঐ দৃশ্যটায় অভিনয় করতে হয়েছে।
আরো একটা মজার ঘটনা বলি, নর্থবেঙ্গলে শুটিংয়ের সময় বহু মানুষই দূরদূরান্ত থেকে আমাকে দেখতে প্রতিদিনই হাজির হতেন। কিন্তু তারা এসে তো আর প্রসেনজিতকে খুঁজে পান না। কারণ তারা যে গেটআপে আমাকে দেখে অভ্যস্ত, আমি তো সেখানে সেরকম গেটআপে ছিলাম না। একদিন শুনি, শুটিং দেখতে আসা দুই দর্শক বাজি ধরছে। একজন আমাকে দেখিয়ে বলছেন, ইনিই প্রসেনজিত; অন্যজন বলছেন, অসম্ভব, ইনি প্রসেনজিত হতেই পারে না। হয়ে যাক বাজি।
বাংলানিউজ : ‘মনের মানুষ’ ছবিটি পর্দায় প্রথম দেখার পর আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
প্রসেনজিত : আমার শুধু একটা কথাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল, কী দরকার আর অভিনয় করার ! আমার অভিনয় করার আর দরকার নেই। কিন্তু অভিনয় না করলে চলবে কী করে ! খাবো কী? আমার স্ত্রী সচরাচর ছবি-টবি দেখেন না। ঘরসংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এবার আমি জোর করে তাকে পাঠালাম ‘মনের মানুষ’ ছবিটির একটা শো দেখে আসার জন্য। শো দেখে এসে আমার স্ত্রী আমাকে ডেকে বললেন, তোমার আর অভিনয় করার দরকার নেই। তুমি তোমার অভিনয় জীবনের সেরা কাজটা করে ফেলেছো। আমরা কষ্ট করে কোনোভাবে চালিয়ে নিতে পারবো, তুমি আর অভিনয় করো না। আসলে লালন চরিত্রে অভিনয়ের পর আমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। এটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।
বাংলানিউজ : ছবিতে অভিনয়ের পর আপনি নাকি অনেক বদলে গেছেন?
প্রসেনজিত : কথাটা খানিকটা সত্যি। আসলে ফকির লালন আমাকে কিছুটা বদলে দিয়েছেন। আগে আমি খুব সহজেই রেগে যেতাম। ‘মনের মানুষ’ ছবিতে কাজ করার পর রাগটা আমার একদম কমে গেছে। আমি এখন সহজে রাগি না। ফকির লালন আমাকে সহিষ্ণু হতে শিখিয়েছেন, মানুষকে ক্ষমা করতে শিখিয়েছেন।
বাংলানিউজ : উত্তম কুমারের পর আপনাকেই কলকাতার সবচেয়ে সফল নায়ক হিসেবে ধরা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আপনি শীর্ষস্থান ধরে রেখেছেন। আপনার সাফল্যের রহস্য কী ?
প্রসেনজিত : প্রথমেই বলে রাখি, উত্তম কুমারের পায়ের ধুলোরও যোগ্য আমি নই। সাফল্য ধরে রাখা নিয়ে আসলে আমি কখনো ভাবিনি। আমার পেশা অভিনয়। পেশার প্রতি সম্মান ও সততা বাজায় রেখে কাজ করছি। এর বাইরে অন্য কোনো রহস্য আছে কিনা, আমার জানা নেই।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশের ছবি সম্পর্কে আপনার ধারণা?
প্রসেনজিত : বাংলাদেশের ছবি দেখার সুযোগ-সময় নিয়মিত পাই না। কলকাতার বিভিন্ন ফিল্ম উৎসবে বাংলাদেশের ছবি আগ্রহের সঙ্গে দেখে থাকি। তাছাড়া কিছু খোঁজখবরও রাখার চেষ্টা করি। একটা সময় তো বাংলাদেশে বেশ ভালো ছবি তৈরি হতো। মাঝে কিছুদিন বাজে সময় গেছে। এখন আবার ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে বলে শুনেছি। বাংলাদেশের এই সময়ের কিছু বাণিজ্যিক ছবিও ডিভিডিতে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের ছবি প্রযুক্তিগতভাবে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আসা দরকার।
বাংলানিউজ : আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা?
প্রসেনজিত : অভিনয় ছাড়া আর কিছু পারি না। তাই অভিনয় করেই আমাকে খেয়ে-পড়ে বাঁচতে হবে। অভিনয় ছাড়া আর কোনো ভবিষ্যত পরিকল্পনা কথা মাথায় নেই, তবে ‘মনের মানুষ’ ছবিতে অভিনয়ের পর এখন আমাকে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০৪০, ডিসেম্বর ০৬, ২০১০