সাদী মোহাম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদ, আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের দুই ধ্রুবতারা। একজন গানের মানুষ, অন্যজন নাচের।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন তারা, বলেছেন চাওয়া-পাওয়া আর আনন্দ-বেদনার নানা কথা। সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশ বাংলানিউজের পাঠকের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সেই বাড়িতে বসেই কথা হলো সঙ্গীতশিল্পী সাদী মোহাম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদের সঙ্গে। যদিও আগের সেই বাড়ির কনক্রিটের কাঠামো ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। একাত্তরের ২৬ মার্চ অবাঙালিরা এই বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেদিন এই বাড়ির সামনেই হত্যা করা হয় তাদের পিতা শহীদ সলিমুল্লাহকে।
শুরুতে কথা বললেন ছোটভাই শিবলী মোহাম্মদ। তিনি বলেন, আমার বাবা ছিলেন প্রাণখোলা মানুষ। শুরু থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা। একাত্তরের ২৩ মার্চ তিনি আমাদের বাসার ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন।
পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নানা কার্যক্রমের নীতি-কৌশল নির্ধারণের জন্য আমাদের বাসায় প্রায়ই মিটিং হতো। ২৫ মার্চ রাতেও মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম জিকু, শেখ কামালসহ গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেকে। মোহাম্মদপুরে আমাদের নিজস্ব বাসভবনের আশেপাশে তখন বিহারিসহ প্রচুর অবাঙালিরা থাকতো। এমনিতে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়মিত আসা যাওয়ার কারণে তারা যে এতটা বিষিয়ে আছে তা বোধহয় বাবাও টের পাননি।
২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর সকালে অনেকেই বাবাকে বলেছেন, আপনার এখানে থাকা নিরাপদ নয়। বাবা উড়িয়ে দিয়েছেন, বাড়িঘর ফেলে কই যাবো? কিচ্ছু হবে না। ২৬ মার্চ আমাদের নিষেধ না শুনেই তিনি জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যান। নামাজ শেষে হঠাৎ আমাদের বাসার পেছন থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। আমাদের চেনা প্রতিবেশী অবাঙালিরাই বাবাকে মসজিদ থেকে ধাওয়া করে। তিনি প্রাণ বাঁচাতে বাসার বাথরুমে এসে আশ্রয় নেন।
অবাঙালিরা আমাদের বাসা ঘিরে রাখে এবং অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদসহ হামলা চালায়। তারা বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আমরা যে যেভাবে যেদিকে পারি ছুটে পালাই। দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে আমার মায়ের দুটি পা ভেঙে যায়।
অবাঙালিরা পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে আওয়ামী লীগ নেতা সলিমুল্লাহ বাসার পেছনের দিকের দেয়াল টপকে পালিয়ে বাঁচতে চান। কিন্তু পারেননি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বড় ছেলে সাদী মোহাম্মদ। চোখের সামনে দেখেছেন বাবার হত্যাকাণ্ড। সেই মর্মান্তিক ঘটনা কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বাবাকে পালাতে দেখে হাতে বিশাল একটা ড্যাগার নিয়ে ছুটে আসেন অবাঙালি এক প্রতিবেশী। তিনি ছিলেন আমদের পরিচিত। এয়ারফোর্সে চাকরি করতেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে তিনি ধারালো ছুরিটা বাবার কাঁধে বসিয়ে দিলেন। বাবা আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আমি আমার রক্তাক্ত বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। আমার শরীর বাবার রক্তে ভিজে গেল। বাবা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। বললেন, তুই পালা... নিজের প্রাণ বাঁচা।
প্রাণ বাঁচাতে আমি পাশের এক বাসার উঠানে ঢুকতেই দেখি, ১৫-২০টা লাশ পড়ে আছে। অবাঙালিরা তাদের হত্যা করেছে। আতংকে আমি ছুটলাম পরের বাসায় আশ্রয় নিতে। তারা বাঙালি। আমাদের সঙ্গে তাদের ছিল সুসম্পর্ক। কিন্তু তারা আমাকে জায়গা দিল না, বের করে দিল। পরে কলতলায় পরিবারের অন্যদের দেখা পাই। আমরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র চলে যাচ্ছিলাম, তখন শেষবারের মতো দেখলাম আমার বাবা রক্তাক্ত নিথর দেহটা রাস্তায় পড়ে আছে।
শিবলী মোহাম্মদ জানালেন, তাদের বাসার পাশের মসজিদের ইমামের কাছ থেকে শুনেছেন যে, রাতে আর্মিরা আসে। তার বাবার মৃতদেহটা অনেকের সঙ্গে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে মাটি চাপা দেয়। ঐ জায়গাটিকে তারা এখন বাবার কবর হিসেবে জানেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পরিবারটির সদস্যরা এখানে-সেখানে নানা জায়গায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আবার অনেক আত্মীয়-স্বজনও তাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেয়েছেন। তাই নিরাপত্তার জন্য একেকবার একেক জায়গায় ছুটতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর আরেক বাস্তবতার মুখোমুখি হন তারা। ছয় ভাই আর চার বোনের পরিবারটির টিকে থাকার সংগ্রাম শুরু হয়। এ বিষয়ে শিবলী মোহাম্মদ বলেন, শহীদ পরিবার হিসেবে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সাহায্য আমরা পাইনি। আবেদন জানিয়েও পাইনি। সংগ্রামটা করেছেন আমার মা। তিনি সেলাইয়ের কাজ জানতেন। তার সেলাইয়ের কাজই হয়ে উঠে আমাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। আমাদের ১০ ভাইবোনকে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করেছেন। বড় করে তুলেছেন।
রাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা এতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, অথচ কেউ আমাদের খোঁজও রাখেনি। বরং আমাদের পৈত্রিক বাড়িটিকে বিহারিদের সম্পত্তি হিসেবে দেখানোরও পাঁয়তারা হয়েছে। মামলা হয়েছে, মামলায় অবশ্য আমরাই জিতেছি। বিএনপি আমলে আমরা বার বার হয়েছি বঞ্চনার শিকার। আমাদের দুই ভাই সেই আমলে ছিলাম কালো তালিকাভুক্ত শিল্পী। শিল্পকলা একাডেমীতে নাচের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমাকে এমন অপদস্থ করা হতো যে, শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।
কথা প্রসঙ্গে খানিকটা ক্ষোভ নিয়ে সাদী মোহাম্মদ বললেন, আমার বাবা শহীদ হয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে একটিই সম্মান পেয়েছেন। তার নামে মোহাম্মদপুরে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। আর কিছুই পাইনি, অবশ্য আমরা চাইও না। আমি গান নিয়ে আছি, শিবলী নাচ নিয়ে আছে। দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেলেও গত ৩৯ বছরে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমাকে গান পরিবেশনের জন্য ডাকা হয়নি।
শিল্পী হিসেবে বঙ্গভবনে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। এ বছর অবশ্য একটা অনুষ্ঠানে ভুল করেই বোধহয় আমাকে ডাকা হয়েছিল। বাজারে আমার ৫৮টি গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে। কিন্তু শিল্পী হিসেবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বিদেশে কোনো সাংস্কৃতিক সফরে যাওয়ার ডাক আসেনি। এবার ডাকা হলেও আমি তা প্রত্যাখান করেছি। বছরে তো বহুবার বিদেশে গান পরিবেশন করতে যাই। সরকারিভাবে নাই-বা গেলাম। এত বছর যখন যাইনি আর যেতেও চাই না।
একই প্রসঙ্গে শিবলী মোহাম্মদ বললেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়ার অপরাধে বিএনপি-জামায়াত আমলে আমরা ছিলাম সরকারিভাবে নিষিদ্ধ শিল্পী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সেই কালো তালিকা সাদা হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলেও সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদের ডাকা হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সাদী মোহাম্মদের আর নৃত্যশিল্পী হিসেবে যদি আমার একটা অবস্থান না থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই দেশে-বিদেশে পারফর্ম করার জন্য এত আমন্ত্রণ পেতাম না। নিজেদের পরিচয়েই এখন আমরা এগিয়ে যেতে চাই।
সাদী মোহাম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাদের মায়ের। মা ছিলেন সংস্কৃতিমনা। তিনি গান-বাজনা পছন্দ করেন। তাই চাইতেন, তার সন্তানদের মধ্যে কেউ যেন বড় শিল্পী হয়। দুই ভাই মায়ের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। তারা চান, মায়ের আরেকটা প্রত্যাশা যেন পূরণ হয়। মা বেঁচে থাকতে থাকতে যেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারেন।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭৫০, ডিসেম্বর ৯, ২০১০