হতাশা আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ২০১০ সাল পার করেছে দেশের সঙ্গীতাঙ্গন। অডিও পাইরেসি, প্রযোজক-শিল্পী মতবিরোধ, তারকা শিল্পীদের নীরবতা, প্লেব্যাকে শিল্পীসম্মানী হ্রাস প্রভৃতি নেতিবাচক প্রভাব দেশের মিজজিক ইন্ডাস্ট্রিকে ফেলে দিয়েছে অস্তিত্বের সংকটে।
অডিও বাজার
অডিও প্রযোজকদের সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ বছরের মধ্যে এবারই বাজার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ ছিল। অডিও পাইরেসির কারণে কমে গেছে ক্রেতার সংখ্যা। মাঝে হিন্দি গানের প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমে গেলেও আবার বেড়ে গেছে হিন্দি গানের আগ্রাসন। হিন্দি গানের নকল সিডিতে বাজার সয়লাব হবার কারণে কমে গেছে দেশীয় গানের অ্যালবামের কাটতি। হিন্দি গানের কমমূল্যের সিডির বাজার দখলের কারণে দেশীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো অ্যালবামের পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা লগ্নি করতে ভয় পাচ্ছে।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে পাওয়া এক হিসেবে জানা যায়, ২০০৯ সালে বাজারে অ্যালবাম এসেছিল প্রায় ২০০টি এবং অর্থলগ্নি ছিল দুই কোটি টাকা। ২০০৮ সালে অ্যালবাম বাজারে এসেছিল প্রায় ৩০০টি এবং বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় চার কোটি টাকা। কিন্তু এবছর আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে অ্যালবাম প্রকাশ। ২০১০ সালে প্রকাশিত অ্যালবাম সব মিলিয়ে ১০০ ছুঁতে পারেনি। এ বছর অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে এক কোটি টাকারও কম বিনিয়োগ করা হয়েছে।
আলোচিত অডিও অ্যালবাম
চলতি বছর অডিও সেক্টরে ছিল নবীন শিল্পীদের অ্যালবামের প্রাধান্য। বেশ কিছু ভালো গানের অ্যালবাম বের হলেও বাণিজ্যিকভাবে সফল অ্যালবাম ছিল হাতে গোনা। ২০১০ সালের প্রকাশিত বাণিজ্যিক বিচারে সফল অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে গীতিকার শফিক তুহিনের প্রথম একক ‘স্বপ্ন এবং তুমি’, ক্ষুদে গানরাজ পড়শীর প্রথমএকক ‘পড়শী’, ব্যান্ডদল শিরোনামহীনের ‘শিরোনামহীন রবীন্দ্রনাথ’, কোজআপ তারকা রাজীবের ‘একলা মানুষ’, সালমার ‘বৃন্দাবন’, এলিটা ও মাহাদীর দ্বৈত অ্যালবাম ‘ছায়াপথ’, প্রমিথিউসের ‘ছায়াপথ’, দলছুটের পঞ্চম অ্যালবাম ‘আয় আমন্ত্রণ’ প্রভৃতি।
চলচ্চিত্রের গানের সর্বাধিক সফল অ্যালবামের মধ্যে এ বছর হাবিবের সুর ও সঙ্গীতে ‘প্রজাপতি’ অ্যালবামটি ছিল শীর্ষে। এছাড়া অডিও অ্যালবামের মন্দাবাজারে এ বছর গড়পরতা সফল অ্যালবামের মধ্যে আছে হৃদয় খানের ‘হৃদয় মিক্স-২’, বালামের ‘বালাম-৩’, তৌসিফের ‘অনুকাব্য’, রূপমের ‘জনম জনম’, শাহীন কবির টুটুল পরিচালিত ‘এই তো ভালোবাসা’ এবং বিভিন্ন সময়ে গাওয়া সংগৃহীত গান নিয়ে আসিফের একক ‘দুঃখ নামের ঘুড়ি’ ও মিশ্র অ্যালবাম ‘দ্য হিট অ্যালবাম থ্রি’। অডিও সেক্টরে এ বছর শিল্পী-সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আলোচিত নাম ছিল আরফীন রুমী। একাধিক ব্যবসা সফল অ্যালবামের সঙ্গীত পরিচালনা আর ব্যতিক্রমী কম্পোজিশন দিয়ে তিনি শ্রোতাদের নজর কেড়েছেন। মেধাবী এই শিল্পীর চলচ্চিত্রের গানেও হাতেখড়ি হয়েছে। এছাড়াও আলোচিত মিউজিশিয়ান হাবিব বিজ্ঞাপনের জন্য জিঙ্গেল নির্মাণ করেও বছরের নানা সময় খবরের শিরোনাম হয়েছেন।
তারকাশিল্পীদের অনুপস্থিতি
আগের বছরের মতোই ২০১০ সালে অডিও সেক্টরে তারকা শিল্পীদের বেশ অনুপস্থিতি দেখা গেছে। দেশবরেণ্য শিল্পীদের গানের অডিও অ্যালবাম বের না হওয়ার কারণে ভক্ত-শ্রোতারা অনেকটাই হতাশ হয়েছে। গত তিন দশক অডিও বাজারে তারকা শিল্পীদের এমন অনুপস্থিতি দেখা যায়নি। শিরোনামহীনের রবীন্দ্রসঙ্গীত আর বছরের শেষভাগে দলছুটের অ্যালবাম ছাড়া দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডের সলো বা মিক্সড অ্যালবাম এবার বের হয়নি। ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাইলস, ফিডব্যাক, ঢাকা ও মাকসুদ, আর্টসেল এবং ব্লাকের কোনও অ্যালবামই এবার বের হয়নি। পাশাপাশি বিভিন্ন গানের তারকা শিল্পীদের অ্যালবামও ছিল হাতে গোনা।
বছরের বিভিন্ন সময়ে কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস আরা, বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভীন, আঁখি আলমগীর,এসডি রুবেল ও শুভ্রদেবের একক অ্যালবাম বের হলেও বের হয়নি নতুন প্রজন্মের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী হাবিব, তপু, ফুয়াদ,তপু, কণা ও মিলার কোনও অ্যালবাম। তবে মিশ্র অ্যালবামের মধ্যে হাবিব, ন্যান্সি, মিলাদের উপস্থিতি কিছুটা পাওয়া গিয়েছে।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির আলোচিত ঘটনা
২০১০ সালের শুরুতেই মাইলস থেকে শাফিন আহমেদ বেরিয়ে যান। দীর্ঘ ২৫ বছরের সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন করে তিনি গড়ে তোলেন নিজস্ব ব্যান্ড দল ‘রিদম অব লাইফ’। এই দলের ব্যানারে তিনি অ্যালবাম বের করারও ঘোষণা দেন। তবে অ্যালবাম তো বেরই হয়নি, বরং বছরের শেষে শাফিন আবার মাইলসে যোগ দেন। ফলে মাইলস ভক্তরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
বছরজুড়ে বিভিন্ন কারণে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ খ্যাত এ তারকা বছরের শুরুতেই ঘোষণা দেন তিনি আর কোনও নতুন অ্যালবাম এবং প্লেব্যাক করবেন না এবং তার কিছুদিন পরে চট্টগ্রামের ফয়’স লেকে আয়োজিত এক কনসার্টে পারফর্ম শেষে তিনি আর স্টেজ শো না করারও ঘোষণা দেন। ফলে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আসিফের অগণিত ভক্ত মনোুণœ হন।
এর মাঝখানে তিনি তরুণ সুরকার-গীতিকার-শিল্পী ও যন্ত্রীদের নিয়ে গঠন করেন সংগঠন ‘আরওয়াইএমবি’। এবারই প্রথম আসিফ রিয়েলিটি শোর বিচারক হিসেবে টেলিভিশনের পর্র্দায় হাজির হয়েছেন।
এ বছরের শেষের দিকে ব্যান্ডের গানের ভক্তরা আরেকটি চমকের স্বাদ পান। দেশের অন্যতম প্রবীণ ব্যান্ডদল আর্ক-এ আবারও একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান টুলু এবং হাসান। এখন থেকে হাসান আর্কের নামেই গান করবেন।
বছরের অন্যতম চমক হলো পপ তারকা ফেরদৌস ওয়াহিদের চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা। ‘কুসুমপুরের গল্প’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন তিনি।
এছাড়াও পপগায়িকা তিশমা নিজের নামে একটি নতুন ব্যান্ড দলের নাম ঘোষণা করেন এবং দেশের প্রথম নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মিলা ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ নামে একটি রেকর্ডিং স্টুডিও গড়ে তোলেন। ।
রোগ-শোকের বছর
২০১০ সাল আমরা সঙ্গীতাঙ্গনের ছিল রোগ-শোকের বছর। এ বছরের ৩ নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও সংগঠক কলিম শরাফী।
পপগুরু আজম খান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বছরের অনেকটা সময় ধরে সিঙ্গাপুরে চিৎকিসাধীন রয়েছেন। জনপ্রিয় দুই বাউল শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া ও আবদুর রহমান বয়াতীও দুরারোগ্য রোগে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া বছরের মাঝামাঝি সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মুক্তির গানের অন্যতম শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্য।
নজরুল সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তী ফিরোজা বেগমও কিডনির জটিলতার কারণে বিদেশে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বছরের বিভিন্ন সময়ে এসব শিল্পীর চিকিৎসা এবং তাদের সাহায্যার্থে বিভিন্ন কর্মকান্ডে ব্যস্ত সময় পার হয়েছে।
প্রতিভা অন্বেষণের কার্যক্রম
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘কোজআপ ওয়ান’ এ বছর অনুষ্ঠিত হয়নি নানা জটিলতার কারণে। চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠের কার্যক্রম চলমান থাকলেও তা আগেরবারের মতো সাড়া ফেলতে পারেনি। মেরিডিয়ান-চ্যানেল আই ুদে গানরাজ, ব্লাকহর্স আরটিভি গোল্ডেন কি মোটামুটিভাবে সাড়া ফেলেছে।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া বিজিএমইএ এবং গানচিল-এর উদ্যোগে আয়োজিত গার্মেন্টসকর্মীদের নিয়ে সঙ্গীতের প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম ‘গর্ব’ ভালোই সাড়া ফেলেছে।
কনসার্ট ও লাইভ সঙ্গীতানুষ্ঠান
এ বছর অন্য বছরগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি স্টেজ কনসার্ট হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে অনেক কনসার্ট।
ব্যান্ডদলগুলোর শীর্ষ সংগঠন বামবা অনেক বছর পর এবার দুটি কনসার্টের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে একটি ৩০ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার জন্য, অপরটি ৩ নভেম্বর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। দুটি কনসার্টই অনুষ্ঠিত হয়েছে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে।
বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারি ধানমন্ডির আবহনী মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘দিন বদলের কনসার্ট’। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্পী ও মিউজিশিয়ানদের অংশগ্রহণে ৩ মার্চ আগারগাঁও বাণিজ্যমেলার মাঠ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ‘আর্ন্তজাতিক সঙ্গীত উৎসব’। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এ বছর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিন গ্রামীণফোনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ‘আমার দেশ আমার গর্ব’ শীর্ষক জাতীয় সঙ্গীতের কনসার্ট। যদিও এতে জাতীয় সঙ্গীতকে বিকৃত করে গাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বছরজুড়ে দেশের সব স্যাটেলাইট চ্যানেলই গভীর রাতে অনএয়ার করেছে গানের অনুষ্ঠান স্টুডিও লাইভ কনসার্ট। ঈদের সময় চ্যানেলগুলোর এ আয়োজন আরও বেশি বেড়ে গিয়েছিল। একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল কলকাতার সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে এসে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও আরটিভির ঈদের বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান নুরজাহান আরটিভি স্টুডিও কনসার্টটি ভালো সাড়া ফেলেছে।
বিদেশী শিল্পীদের মুখর আগমন
অন্তর শোবিজের আয়োজনে ১০ নভেম্বর শাহরুখ খানের ওপেন এয়ার কনসার্ট ‘কিং খান লাইভ ইন ঢাকা’ ঝড় তোলে সারা দেশে। এতে আরো পারফর্ম করেন রানী মুখার্জি, ইশা কোপিকার, অর্জুন রামপাল, শেফালি জরিওয়ালা, সঙ্গীতশিল্পী নিরাজ শ্রীধর, নৃত্যপরিচালক গণেশ হেগডেসহ বলিউড থেকে আসা ৪৮ সদস্যের একটি দল।
এছাড়া ভারতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল ২৭ মে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি কনসার্টে অংশ নেন। ‘এ নাইট উইথ হরিহরণ’ অনুষ্ঠিত হয় ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে।
১৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পাকিস্তানের তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘জাল’ একটি কনসার্টে অংশ নেয় । ১ নভেম্বর সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ইন্ডিয়ান আইডল-৫ লাইভ ইভনিং’ অনুষ্ঠানে বাংলা-হিন্দি গান পরিবেশন করেন রাকেশ, ভূমি ও শ্রীরাম।
নতুন নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ও উদ্যোগ
বছরের শুরুর দিকে প্রবীণ শিল্পী আলাউদ্দিন আলী ও এন্ড্রু কিশোরের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ‘এলসিএস গিল্ড’ এবং শিল্পী আসিফ আকবরের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে তরুণ গীতিকার,সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পীদের সংগঠন ‘আরওয়াইএমবি’। এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য দেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রিকে পাইরেসির হাত থেকে রা করা এবং গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের কপিরাইট প্রণয়ন। এসব সংগঠনের কর্তব্যক্তিরা নানা ধরনের কলাকৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গীতকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং দেশের মানুষকে সহযোদ্ধা হিসেবে থাকার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭১৫, ডিসেম্বর ৩০, ২০১০