নাটকপাড়ায় যারা নিয়মিত তারা তো বটেই, যারা কালেভদ্রেও যান তাদেরও চোখ এড়ায় না, উৎসব আর নাটকের বর্ণিল পোস্টারে ছেয়ে যাওয়া দেয়ালগুলো। বছরজুড়ে প্রায় গোটা বিশেক নতুন নাটকের পোস্টার দেখা গেছে নগরীর নানা মঞ্চে।
তাই বলে ভাবা যাবে না রাজধানীর নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করা প্রায় ৭০টি দল মিলে মাত্র বিশটি নাটক মঞ্চে এনেছে। এ বছর চারটি মঞ্চে প্রায় ৪০টি নতুন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে আর পুরাতন নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে প্রায় হাজারখানেক। আশার বিষয় এ বছর নতুন একটি মঞ্চও যোগ হয়েছে। পুরান ঢাকায় অবস্থিত এ মিলনায়তনের নাম ‘জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’।
ঢাকার মঞ্চে ভারত, সুইডেন, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে আমাদের মঞ্চে দেখা গেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দারুণ সমন্বয়। প্রচলিত প্রসেনিয়াম মঞ্চের সাথে বাঙালির খোলা বা এরেনা মঞ্চে নাটক দেখা গেছে বেশ কটি। সব মিলিয়ে গতানুগতিক নাটকের পাশাপাশি এ বছর নিরীধর্মী নাটকেও ছিল নতুন জোয়ার।
বছরের শুরুতে ১০ জানুয়ারি ‘থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরি’র নতুন নাটক ‘শাইলক অ্যান্ড সিকোফ্যান্টস’ দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। নাট্যপত্রিকা থিয়েটারওয়ালার গঠন করে এ নতুন দল। শাহজাদ ফিরদাউসের উপন্যাস অবলম্বনে হাসান শাহরিয়ার লিখেছেন নাটকটি। নির্দেশনায় ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। বিভিন্ন দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে এ নাটকের মঞ্চায়ন চলছে সগৌরবে। হাসান শাহরিয়ার আরও লিখেছেন ‘মগজ-সমাচার’। সাইদ সুমনের নির্দেশনায় নাটকটি করছে থিয়েটার আর্ট ইউনিট।
জানুয়ারির ২৩ তারিখে সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে উদ্বোধন করে ‘শেষ সংলাপ’ নাটকটি। তাওফিক আল হাকীমের সুলতানুজ জান্নাম অবলম্বনে নাটকটি লিখেছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ ও ম সাইফুল ইসলাম। ভারতের মিনার্ভা মঞ্চে প্রথম মঞ্চায়িত এ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আকতারুজ্জামান। এর আগে ৭ জানুয়ারি ‘নাট্যকেন্দ্র’ মঞ্চে আনে ‘ডালিম কুমার’ নাটকটি। শুভাশিস সিনহার লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক।
নতুন নাটকের দল ‘নাট্যবেদ’ প্রথম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আনে ‘মন পবনের নাও’ নাটকটি। বিভাষ চক্রবর্তীর মাধব মালঞ্চ কইন্যা অবলম্বনে সংযোজন, পরিমার্জন ও নির্দেশনার কাজটি করেছেন দীপক রায়। নাটকটি ময়মনসিংহের শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে ৮ মে উদ্বোধন হয়। এদিকে ‘সুবচন নাট্যসংসদ’ বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের জীবন নিয়ে মঞ্চে আনে ‘মহাজনের নাও’ । এটি জাতীয় নাট্যশালার পরীণ থিয়েটার হলে উদ্বোধন হয় ১৮ জুন। শাকুর মজিদের লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী।
মে মাসে আরণ্যক নাট্যদলের উদ্যোগে ব্যতিক্রমী নাট্য প্রযোজনা ছিল ‘হুজ ইন কন্ট্রোল’। এতে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও হংকংয়ের শিল্পীরা অভিনয় করেন। একই দল ৬ অক্টোবর স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চে আনে ‘হ্যামলেট’ অবলম্বনে নিরীাধর্মী প্রযোজনা ‘টুবি অর নট টু বি’ । এটির নির্দেশনা দিয়েছেন আবুল হাসেম মাসুদুজ্জামান । ৭ অক্টোবর একই দল একই হলে উদ্বোধন করে ইডিপাস অবলম্বনে ‘ইতি ইয়োকাস্তে’। এটি মঞ্চে আনেন তরুণ নির্দেশক দীপক সুমন।
নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে থিয়েটারের ‘বারামখানা’ নাটকটির উদ্বোধন হয় ২২ অক্টোবর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনের মানুষ উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটকটি লিখেছেন পান্থ শাহরিয়ার আর নির্দেশনা দিয়েছেন ত্রপা মজুমদার। ৭ নভেম্বর জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে উদ্বোধন হয় সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। পালাকার পরিবেশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা ও লেখা বাংলার জীবন ও প্রকৃতি অবলম্বনে রচিত এই নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন আতাউর রহমান।
নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ১০ ডিসেম্বর নতুন নাটক হিসেবে মঞ্চে আনে মনোজ মিত্রের ‘ঘাষিরাম কোতোয়াল’। নাটকটির উদ্বোধন হয় শিল্পকলার পরীণ থিয়েটার হলে। নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার। নাগরিক নাট্যাঙ্গন ১৪ ডিসেম্বর মূল মিলনায়তনে উদ্বোধন করে ‘পুষি বিড়াল ও একজন প্রকৃত মানুষ’ নাটকটি। হৃদি হকের লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন লাকী ইনাম। ‘থিয়েটার আরামবাগ’ এ বছর মঞ্চে এনেছে গাজী রাকায়েতের নির্দেশনায় ‘জন্মসূত্র’। ২৫ অক্টোবর ‘জলমাংক’ নাটকটির উদ্বোধন হয় পরীণ থিয়েটার হলে। নাসরীন মুস্তাফার লেখা ‘পদাতিক নাট্যসংসদে’র এই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন মীর মেহবুব আলম নাহিদ।
এ বছর দেশ নাটক শামসুল আলম বকুলের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে ‘প্রাকৃত পুরঙ্গনা’। নতুন দল ‘নটরণ’ প্রথম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আনে মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘অমাবস্যার কারা’। কুমার প্রীতিশ বলের লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন দেবাশীষ ঘোষ।
‘দশরূপক থিয়েটার’ নায়লা আজাদ নূপুরের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’। ফরাসি নাটক ‘ঠাকুর ঘরে কে রে?’ আল নোমানের অনুবাদ ও নির্দেশনায় বছরের আরেকটি নতুন নাটক। শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র ও নাটুকের যৌথ প্রযোজনা এটি। শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে আনে গোলাম সারোয়ারের রচনা ও নির্দেশনায় ‘তেমজুর খৈমুদ্দিন’। প্রাঙ্গণে মোরের ‘দ্রোহ প্রেম নারী’ নির্দেশনা দেন রমিজ রাজু।
ঢাকা পদাতিক মঞ্চে আনে কাজী চপলের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ‘পাইচো চোরের কিসসা’। উদীচী নাটক বিভাগ মঞ্চে আনে ‘রাজনৈতিক হত্যা’। ‘সাধনা’ মঞ্চে আনে একক অভিনয়ের নাটক ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’। স্বপ্নদলের এ বছরের নতুন নাটক ‘ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি’। সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা থেকে নাট্যরূপ দিয়েছেন জাহারাবী রিপন। নির্দেশনায় সামাদ ভূঁইয়া ও রওনক লাবণী। শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র মঞ্চে এনেছে ‘ঠিকানা’।
বাংলাদেশ ও বিদেশী শিল্পীদের সমন্বয়ে লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী মুকুল আহমেদের নির্দেশনায় এসেছে লন্ডনের তারা আর্টস প্রযোজিত ‘জুলিয়াস সিজার’। নতুন দল নাটগৌড় মঞ্চে এনেছে তুহিন অবন্তের নির্দেশনায় ‘ন-মানুষ’। আরেক নতুন দল এথিক থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘হাঁড়ি ফাটিবে’। নাট্যতীর্থ এনেছে তপন হাফিজের নির্দেশনায় ‘কন্যাপ্রকৃতি’। রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ অবলম্বনে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘মগজ সমাচার’ । নবনাটের ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’, নাট্যযোদ্ধার ‘কড়াল’। মৈত্রী থিয়েটারের ‘ঈশ্বরা’ বটতলার ‘নয়া ঈশ্বর’, অবয়ব নাট্যদলের ‘ভূমধ্যসাগর’, থিয়েটার স্কুলের ‘সধবার একাদশী’। অঙ্গীকার নাট্যদলের ‘গালিভার ট্রাভেলস’, ঐকিক থিয়েটারের ‘ড্রপআউট’, গতি থিয়েটারের ‘চেলকাশ’। সংলাপ গ্রুপ থিয়েটারের ‘ষোড়শী’। নাট্যপ্রয়াসের ‘নিঃসঙ্গ নিরাময়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় মঞ্চে এনেছে এ বছর ।
‘দ্যাশ বাংলা থিয়েটার’ সেলিম আল দীনের ‘জুলাল’ নাটকটির উদ্বোধন করে স্টুডিও থিয়েটার হলে ৯ ডিসেম্বর। এটির নির্দেশনা দিয়েছেন প্রবীর গুহ। ৩০ ডিসেম্বর উদ্বোধন হবে মণিপুরি থিয়েটারের নাটক ‘কহে বীরাঙ্গনা’।
৩১ ডিসেম্বর স্টুডিও থিয়েটার হলে সংলাপ গ্রুপ থিয়েটার ‘বদনাম’ নাটকটির উদ্বোধন করবে।
নতুন নাটক, দেশে-বিদেশে নাটকের প্রদর্শনী আর বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে এ বছরটি নাটকের জন্য বেশ ভালোই বলা চলে।
বাংলাদেশ সময় ১৮৫০, ডিসেম্বর ৩০, ২০১০