একজন এবি বলিউড ফিল্মডোমে যেমন বয়স ছাপিয়ে তারুণ্যের আলো ছড়াচ্ছেন, আমাদেরও আছেন সেরকমই একজন এবি। তবে তার বিচরণ গানে গানে।
একটি টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় লাইভ মিউজিক কনসার্ট। এ অনুষ্ঠানটি রাত সাড়ে এগারোটায় শুরু হয়ে চলে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সেদিন একটানা সকাল ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি চলল। সবাইকে চমকে দিয়ে টানা সাড়ে সাত ঘণ্টা গান পরিবেশন করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আইয়ুব বাচ্চু এবং তার ব্যান্ড এলআরবি। বাংলাদেশে এত লম্বা সময় ধরে এর আগে কোনো লাইভ কনসার্ট বা টিভি অনুষ্ঠানে গান করার রেকর্ড নেই কারো। রাতভর গানের পাশাপাশি ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়েও দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন আইয়ুব বাচ্চু। বহু শ্রোতার পাশাপাশি অনেক সেলিব্রিটিও ফোন করে তার কণ্ঠে পছন্দের গান শুনতে চান। সবার অনুরোধ রাখতে গিয়ে গাইতে গাইতে কখন যে রাত পোহালো টের পাননি। এই হলেন আমাদের রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু।
আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামে। জন্ম তারিখ ১৬ আগস্ট (জন্মসাল বলতে মানা!)। ডাক নাম রবিন। পরিবারের তেমন কেউ গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ঝোঁক। আধুনিক-লোকগীতি-ক্যাসিক্যালের পাশাপাশি শুনতেন প্রচুর ওয়েস্টার্ন গান।
গানের প্রতি নিজের এই ভালোবাসা সম্পর্কে তিনি বলেন, গান শোনতাম প্রচুর। নিজেও একসময় গাইতে চেষ্টা করলাম। স্কুলে পড়াকালীন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। আর তখন থেকেই ওয়েস্টার্ন মিউজিক ভালো লাগত। শুরু করি গিটার চর্চা। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর হয়ে উঠেন আমার অনুপ্রেরণার উৎস। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে একটা ব্যান্ডদল গড়ি। প্রথমে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘গোল্ডেন বয়েজ’, পরে নাম পাল্টিয়ে রাখা হলো ‘আগলি বয়েজ’। বিয়েবাড়ি, জন্মদিন আর ছোটখাট নানা অনুষ্ঠানে আমরা এই ব্যান্ডদল নিয়ে গান করতাম।
স্কুল-কলেজের ছেলেমানুষি ভুলে বন্ধুরা যে যার মতো একেক দিকে ছড়িয়ে পড়লেও আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক নিয়েই থাকলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ড তখন গান করত। ফিলিংসের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু জড়িত ছিলেন কিছুদিন। ১৯৮০ সালে যোগ দেন ‘সোলস’ ব্যান্ডে। সোলসের লিডগিটার বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন টানা ১০ বছর। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল গড়ে তুললেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি।
নতুন ব্যান্ড গঠন প্রসঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু বলেন, আসলে মিউজিক নিয়ে নতুন কিছু এক্সিপেরিমেন্ট করার ভাবনা থেকেই এলআরবির জন্ম। হার্ড-রক ছিল আমাদের প্রথম পছন্দ। সে সময় দলের লাইন আপ ছিল টুটুল কী-বোর্ড, স্বপন বেজ, জয় ড্রামস আর আমি ভোকাল কাম লিডগিটার।
মজার ব্যাপার হলো, এলআরবি দিয়ে শুরুতে বোঝানো হয়েছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু কিছুদিন পর এক প্রবাসী বন্ধু জানান এই নামে অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যান্ড আছে। তাই প্রয়োজন হয় দলের নাম পাল্টাবার। এলআরবি আদ্যাক্ষর ঠিক রেখে ব্যান্ডের নতুন নাম রাখা হলো ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। শুরুতেই এলআরবি চমক সৃষ্টি করে ডবলস ডেব্যু অ্যালবাম বের করার মধ্য দিয়ে। ‘এলআরবি- ১ ও ২’ নামের এই ডবলসের পর একে একে এ পর্যন্ত ব্যান্ডের আরো ১০টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সালে বের হয়েছিল সর্বশেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।
অডিও সেক্টরের চেয়েও এলআরবিকে বেশি সরব দেখা গেছে দেশ-বিদেশের কনসার্টে। যে কোনো স্টেজ শোতে অংশ নেওয়ার আগে আইয়ুব বাচ্চু পুরো দল নিয়ে প্র্যাকটিস করতে কখনও ভুল করেন না। সারা দিন সময় না পেলে মধ্যরাতে হলেও তিনি প্র্যাকটিস করেন। ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশের কনসার্টে এলআরবি পারফর্ম করেছে। অংশ নিয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি কনসার্টে।
এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় ২০ বছর। এই দীর্ঘ পথচলা সম্পর্কে আইয়ুব বাচ্চু বললেন, এলআরবির মতো আমার বিয়ের বয়সও প্রায় ২০ বছর। এতোগুলো বছরে ব্যান্ডকে যতটা সময় দিয়েছি, আমার পরিবারকেও ততটা দিতে পারিনি। অনেক রকম ঝড়-ঝাপটার মধ্য দিয়ে আমাদের টিকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু শ্রোতাদের ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে ছিল, তাই এতটা পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। শ্রোতারাই আমাদের সব শক্তির উৎস। শ্রোতারা যত দিন চাইবে, তত দিন এভাবেই এলআরবিকে নিয়ে গান করে যাব।
২০ বছর পূর্তিতে এলআরবি নতুন একটি অ্যালবাম শ্রোতাদের উপহার দিতে যাচ্ছে। অ্যালবামটির কাজও শেষ হয়ে গেছে, এখন শুধু রিলিজের অপেক্ষা। ‘যুদ্ধ’ শিরোনামের এ অ্যালবামের সব কটি গানের কথা লিখেছেন সাজ্জাদ হুসাইন। হার্ডরকের পাশাপাশি অ্যালবামটির কয়েকটি গানে রয়েছে সফট-রক ও ফিউশন। তবে অ্যালবামটি বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে দ্বিধায় আছেন এলআরবির সদস্যরা।
এ বিষয়ে আইয়ুব বাচ্চু বললেন, অডিও বাজার এখন মৃতপ্রায়। তাই লাভ তো দূরে থাক, বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাবার আশা করা যায় না। অডিও পাইরেসি তো আছেই, আরো যোগ হয়েছে নতুন অ্যালবাম বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটে আপলোড করে দেওয়ার প্রবণতা। তাহলে পয়সা খরচ করে অ্যালবাম কেনার কী দরকার! কাজেই এখন অ্যালবামের বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কি কোনোভাবে সম্ভব নয়? উত্তরে বললেন, এখান থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব। শুধু দরকার যার যার জায়গায় থেকে একটু সচেতন হওয়া। অডিও একটি শিল্প। আর এই শিল্পের ওপর ভিত্তি করে কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। আমি মনে করি, প্রথমে ওইসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিক হতে হবে এবং শিল্পীদের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে।
সবশেষে আইয়ুব বাচ্চুর কাছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীত শিা ও চর্চার জন্য আমার একটি মিউজিক্যাল একাডেমি করার ইচ্ছা আছে। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের গান একদিন সারাবিশ্বে সমাদৃত হবে। আর এই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয় নিয়েই আমি আর এলআরবি এগিয়ে চলেছি।
আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবির অ্যালবাম
একক : রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৬), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৯), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কী (২০০০), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির গানে মাটির টানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স-ইন্সট্রুমেন্টাল (২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮) ও বলিনি কখনও (২০০৯)।
ব্যান্ড : এলআরবি ১ ও ২ (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০১), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নাই (২০০৫), লাইভ অ্যালবাম ফেরারি মন (আন প্লাগড ১৯৯৬), স্পর্শ (২০০৮)।
এলআরবিতে এখন যারা
আইয়ুব বাচ্চ : লিড ভোকাল ও গিটার
মাসুদ : গিটার
স্বপন : বেইজ
রোমেল : ড্রামস
বাংলাদেশ সময় ২০৫৫, জানুয়ারি ১২, ২০১১