‘গ্রিন পপ’ পরিভাষাটি দেখে চোখ আটকে গেল। দেশে দেশে যে ‘গ্রিন’ আন্দোলন চলছে তা কেবল পরিবেশ-প্রতিবেশের সচেতনতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সম্প্রতি তুরস্কের প্রগতিশীল পত্রিকা ‘হুরিয়াত’ তাদের ওয়েবসাইটের প্রধান সংবাদ হিসেবে ছেপেছে খবরটি। মোটামুটিভাবে শিরোনামটি ছিল ‘মুসলিম পপশিল্পীরা ক্রমাগত মাতিয়ে তুলছেন সঙ্গীতজগৎ। ’ এই প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে সঙ্গীতজগতে জন্মগত ও ধর্মান্তরিত মুসলমান পপতারকাদের অবদান।
বিভিন্ন ভিডিও ওয়েবসাইটে এই ঘরানার শিল্পীদের ক্রমাগত জনপ্রিয়তাকে যাচাই-বাছাই করে সাজানো হয়েছে প্রতিবেদনটি। এই শিল্পীরা তাদের গানের কথায় তুলে ধরছেন ধর্মের বাণী।
সঙ্গীতপ্রেমীরা এই ধরনের গানগুলোর নাম দিয়েছেন ‘গ্রিন পপ’। তবে শিল্পীদের পছন্দ তাদের গানগুলোকে ‘মুসলিম কণ্ঠসঙ্গীত’ বা ‘নাশিদ’ নামেই ডাকা হোক। এগুলোকে দেখা হোক মুসলিম সঙ্গীত-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা হিসেবেই।
গানের কথায় নৈতিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে এই প্রজন্মের মুসলিম শিল্পীরা অনুসরণ করে যাচ্ছেন কিংবদন্তি শিল্পী ইউসুফ ইসলামকে। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে ইসলাম গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত এই ব্রিটিশ শিল্পী ক্যাট স্টিভেন্স নামে পরিচিত ছিলেন। ধর্মীয় ভাবধারায় গান গেয়ে পরবর্তীকালে তিনি পপের জগতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন।
আজ এই পথেই হাঁটছেন সামি ইউসুফ, হামজা রবার্টসন, জাইন ভিঙ্কাসহ অনেকেই। হিপহপ গানের দল ‘নেটিভ দ্বীন’-এর অ্যালবামগুলোও বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এই শিল্পীদের অ্যালবামগুলোর লাখ লাখ কপি বিক্রি হওয়ায় আজ নিশ্চিত করেই বলা যায় মুসলিম পপশিল্পীরা ক্রমাগত মাতিয়ে তুলছেন সঙ্গীতজগৎ।
সামি ইউসুফের কথাই ধরা যাক। ইরানের আজারবাইজানি জাতিভুক্ত এই শিল্পী ১৯৮০ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন সঙ্গীতের আবহ। আঠারো বছর বয়সে তিনি বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেন বিশ্বের সবচে বিখ্যাত সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘রয়েল অ্যাকাডেমি অব মিউজিক’-এ। অল্প সময়েই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে, মুসলিম বিশ্বে। তিনি গান করেন ইংরেজি, তুর্কি, আরবি এবং ফার্সি ভাষায়।
তার প্রথম অ্যালবাম ‘আল মুয়াল্লিম’ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। এর বছর দুয়েক পর প্রকাশিত হয় ‘মাই উম্মাহ’ অ্যালবামটি। ২০০৭ সালে এই শিল্পীর ইস্তান্বুল কনসার্টে জড়ো হয়েছিল আড়াই লাখের বেশি সঙ্গীতপ্রেমী। গত বছর প্রকাশিত তার ‘হোয়ারেভার ইউ আর’ অ্যালবামটি ভেঙ্গেছিল বিক্রির রেকর্ড।
সামিকে নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন করেছিল ‘টাইম’ ম্যাগাজিনসহ খ্যাতনামা সাময়িকীগুলো। ‘টাইম’-এর ভাষায়, সামি ‘ইসলামের সবচেয়ে বড় রক শিল্পী’। আর ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতে ‘সম্ভবত সামি পৃথিবীতে সবচে খ্যাতিমান ব্রিটিশ মুসলমান’। বিবিসি তাকে দিয়েছে ‘দ্য কিং অব মুসলিম পপ’ উপাধি।
এই শিল্পী তার গানের মাধ্যমে প্রচার করে চলেছেন সহনশীলতা ও শান্তির বাণী। কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বমানবতার জন্য।
মনে হয় আমাদের দেশে ইউসুফ ইসলামের নামটি একটু বেশি পরিচিত। এই শিল্পী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিবৃতির মাধ্যমে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি লন্ডনে জন্ম নেন গ্রিক বাবা আর সুইডিশ মায়ের ঘরে। সঙ্গীত জগতে এখনো উজ্জ¦ল হয়ে আছে তার ক্যাট স্টিভেন্স নামটি।
মরক্কোর মারাকেস-এ আজান শুনে ক্যাট উপলব্ধি করেছিলেন, ‘প্রভুর জন্যই সঙ্গীত’। টাকাকড়ি, নাম-যশ কোনোকিছুর জন্যই নয়।
এরপর ১৯৭৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার মালিবু উপকূলে প্রায় ডুবতে বসেছিলেন ক্যাট। মনে মনে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘প্রভু, এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলে বাকি জীবন তোমার জন্য কাজ করে যাব। ’ কাকতালীয়ভাবে একটি ঢেউ এসে ভাসিয়ে তোলে তাকে, ফিরিয়ে আনে বালুকাবেলায়।
ষোল বছর বয়সে ক্যাথলিক স্কুল ছাড়েন ক্যাট। আঠারো বছর বয়সে তার গাওয়া ‘আই লাভ মাই ডগ’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি প্রতিভাবান এই শিল্পীকে।
আগেই লিখেছি ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে ইসলাম গ্রহণ করেন ক্যাট। কিছুদিন পর, ১৯৭৮ সালে নাম নেন ইউসুফ ইসলাম। নবী ইউসুফের নামে নাম। এর অর্থ ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যাদাতা’।
পরবর্তী বছরগুলোতে ইউসুফ গানের কোম্পানিগুলোকে অনুরোধ করেন বাজার থেকে তার অ্যালবামগুলো তুলে নিতে। কিন্তু তার বিশাল জনপ্রিয়তা দেখে কোম্পানিগুলো ফিরিয়ে দেন ইউসুফের অনুরোধ।
বেশ কয়েক বছর সঙ্গীতের জগৎ থেকে দূরে থাকলেও তিনি আবার ফিরে আসেন মঞ্চে। শ্রোতাদের গেয়ে শোনান ইংরেজি ভাষার ‘নাশিদ’। তার আরবি গান ‘তালিয়াল বেদরু আলাইনা’ ও ইংরেজি গান ‘অ্যা ইজ ফর আল্লাহ’ ইন্টারনেটে সব রেকর্ডই ভেঙ্গেছিল।
১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া টম রবার্টসন ২১ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। টম শব্দটি বদলে রাখেন হামজা। তাই এখন তার পরিচয় হামজা রবার্টসন নামেই।
প্রথম দিনগুলোতে তিনি গানের মাধ্যমে ভক্তদের আহ্বান জানাতেন ইসলাম গ্রহণে। পরে বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচিত হন সুফিদর্শনে। লন্ডনে এক গানের আসরে তাকে আবিষ্কার করেন শিল্পী ইউসুফ ইসলাম।
নারী ও শিশুদের জন্য কাজ করে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন হামজা। ২০০৯ সালে প্রকাশিত তার প্রথম অ্যালবাম ‘সামথিং অ্যাবাইট লাইফ’ তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে খুব জনপ্রিয়। ইউসুফের সঙ্গে তার গাওয়া ‘ইউর বিউটি’ গানটিও ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইটগুলোতে খুব জনপ্রিয়।
আরেক জনপ্রিয় শিল্পী জাইন ভিঙ্কা-র জন্ম ১৯৭৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯৯৪ সালের এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তিনি সাফল্য লাভ করেন। দু বছর পর শুরু করেন সঙ্গীত ক্যারিয়ার। ইউসুফের সঙ্গে গাওয়া তার বিভিন্ন গান মুসলিম বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়।
জাইনের নাম গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে ২০০৯ সালে পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর পর। কেননা, তিনি দাবি করেছেন তার গাওয়া ‘গিভ থ্যাঙ্কস টু আল্লাহ’ গানটি আগে জ্যাকসন গেয়েছিলেন। তিনি আরো দাবি করেন, মৃত্যুর আগে জ্যাকসন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
ইতিমধ্যেই গান নিয়ে জাইন ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশে দেশে। তবে শিশুদের জন্য টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াতেই তার আগ্রহ বেশি।
সঙ্গীতজগতে প্রথম হিপহপ ঘরানায় ‘নাশিদ’ গেয়েছেন গানের দল ‘নেটিভ দ্বীন’। ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রো-আমেরিকানদের লাইফস্টাইল হয়ে গিয়েছিল হিপহপ গান। সেই ঘরনার গানগুলোর ওপর ভিত্তি করে ২০০০ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে গড়ে উঠে এই সঙ্গীতদলটি।
নাঈম মোহাম্মদ, জশুয়া সালাম এবং আবদুল মালিক আহমেদ হিপহপের ভঙ্গিতে ইসলামি গান গেয়ে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন আমেরিকার সঙ্গীতাঙ্গনে। শুধু গানের কথাতেই নয়, তারা বিশিষ্টতা আনেন বাজনাতেও। এই দলটি গানে শুধু পারকার্শন ব্যবহার করেন।
ইউসুফ ইসলামের নেতৃত্বে ‘গ্রিন পপ’ বা ‘নাশিদ’ নামে সঙ্গীতের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন ওয়েবসাইট দেখার পর এই ধারণাই আসে যে, এই ধারা দিনে দিনে বেগবান হয়ে সুস্থ গানের চর্চা ছড়িয়ে দিচ্ছে তরুণদের ভেতর।
বাংলাদেশ সময় ০০৩৭, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১১