সমাজ-সভ্যতাকে গতিশীল করে তুলতে যুগে যুগে নারী পালন করে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারীর এই সুকীর্তিকে স্বীকৃতি জানাতে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ৮ মার্চ পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
সারা যাকের
এমন একটা সময় ছিল যখন এ দেশে থিয়েটার করার জন্য নারীদের খুঁজে পাওয়া যেতো না। স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশের থিয়েটারকে আলোকিত করতে যে কজন নারী এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে অন্যতম সারা যাকের। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি তখন মাত্র ম্যাট্রিক পরীা দিয়েছি। সে সময় নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হই। সময়টি ছিল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাস। দলে যোগ দিয়ে নাগরিকের হয়ে ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করি। এতে আমার চরিত্রের নাম ছিল ‘কণা’। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাটকটি প্রথম মঞ্চে আসে। । দলে আমার দ্বিতীয় নাটক ছিল বিদগ্ধ রমণীকুল। এখানে আমি মায়ের চরিত্রে অভিনয় করি। দুটি নাটকেরই নির্দেশনা দিয়েছিল আলী যাকের। এরপর একে একে অভিনয় করলাম ‘নিষিদ্ধ পল্লী’সহ একাধিক নাটকে। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের হয়ে প্রথম নির্দেশনা দিই ১৯৯০ সালে। নাটকের ‘নাম মুখোশ’। মঞ্চনাটকে নিজের কর্মকান্ড সম্পর্কে এভাবেই বললেন সারা যাকের।
শুধু অভিনয় বা নির্দেশনা নয়, একই সঙ্গে সারা যাকের একজন দক্ষ সংগঠক। নিজদলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি দেশের নাট্যকর্মীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেছেন। মঞ্চের পাশাপাশি টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তবে থিয়েটারে কাজ করেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পান। থিয়েটারে নারীর অবস্থান ও সমস্যার কথা জানতে চাইলে সারা যাকের বললেন, আসলে থিয়েটারে নারী বা পুরুষ খুব একটা ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই নাট্যকর্মী, সেটাই আমাদের বড় পরিচয়। তবে এটা ঠিক যে, থিয়েটার চর্চা চালিয়ে যেতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা সমস্যায় পড়ে বেশি। বিশেষ করে আমি দেখেছি, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর বাড়িতে গিয়ে অনেক মেয়েই থিয়েটার চালিয়ে যেতে পারে না। অথচ মিডিয়ার অন্যসব মাধ্যমের চেয়ে থিয়েটারেই মেয়েরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে প্রয়োজন সচেতনতা।
ফাহমিদা নবী
সুরের উত্তরাধিকার নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন ফাহমিদা নবী। ছোটবোন সামিনাকে নিয়ে ছোটবেলা থেকে শুরু হয় তার সঙ্গীত চর্চা। বাবা বরেণ্য শিল্পী মাহমুদুন্নবীর মৃত্যুর পর অজানা কারণে ফাহমিদা নবী সঙ্গীত থেকে দূরে সরে আসেন, কানাডায় বেছে নেন প্রবাসী জীবন। কিন্তু একরাতে স্বপ্নে বাবা তার সামনে এসে হাজির হন। ফাহমিদাকে আদেশ করেন, সুরের ভুবনে ফিরে আসতে। তিনি ফিরে আসেন এবং গানের জগতে শুরু হয় তার বলিষ্ঠ পদচারণা। এ বিষয়ে ফাহমিদা নবী বলেন, আসলে বাবা যদি এভাবে স্বপ্নের মাঝে আমাকে আদেশ না করতেন, তাহলে হয়তো গানের জগতে আমার ফেরাই হতো না। এখন গান করার সময় আমার মনে হয়, বাবা বুঝি আমার গান শুনছেন। তাই সবসময় চাই শুদ্ধ সুরের গান গেয়ে যেতে।
ফাহমিদা নবী এখন গান নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। অডিও আর প্লে-ব্যাক, দুই জায়গাতেই গড়ে তুলেছেন আলাদা অবস্থান। সম্প্রতি তিনি প্রশংসিত হয়েছেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের লেখা ও সুর করা গান গেয়ে। গানের ভুবনে নারীর অবস্থান জানতে চাইলে ফাহমিদা নবী বললেন, আমাদের দেশে তো অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন আছে। সেগুলোর মধ্য দিয়েই মেয়েদের এগিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, একটা মেয়ে ছোটবেলা খুব ভালো গান করছে। পরিবারও তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। সেই মেয়েটা বড় হয়ে আর গান চালিয়ে যেতে পারছে না। পরিবারই তার সঙ্গীতচর্চার বিরুদ্ধে দেওয়াল দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আসলে মেয়েদের গানের চর্চা চালিয়ে যেতে হলে পারিবারিক সমর্থন বড় প্রয়োজন।
মৌসুমী
আরিফা জামান মৌসুমী, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আশীর্বাদ। সেই ১৯৯১ সাল থেকে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মধ্য দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রে শুরু হয়েছিল মৌসুমীর পথযাত্রা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ঢালিউডের শীর্ষ নায়িকার জায়গাটি জিতে নেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে তিনি অভিনয় করছেন বেছে বেছে। ভালো ছবি ছাড়া এখন আর কাজ করছেন না। শুধু অভিনয়ই নয়, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন মৌসুমী। তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’। মুশফিকুর রহমান গুলজারের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন কাজী নজরুলের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘মেহের নিগার’ চলচ্চিত্র। মৌসুমী জানান, এ মুহূর্তে নতুন কোনও ছবি পরিচালনার পরিকল্পনা তার নেই । তিনি স্ক্রিপ্ট খুঁজছেন। ভালো স্ক্রিপ্ট পেলেই পরিচালনার কথা ভাববেন। ছোটপর্দার নাটকেও অভিনয় করছেন মাঝেমধ্যে।
যে নারী রাঁধতে জানেন, তিনি ভালো চুল বাঁধতেও জানেন; তা প্রমাণ করেছেন মৌসুমী। শোবিজে কাজ করার পরও ঘর-সংসার ঠিক রেখেছেন, তৈরি করেছেন দৃষ্টান্ত। চলচ্চিত্রে সাফল্যের নেপথ্যের কথা জানতে চাইলে মৌসুমী বললেন, নিজের ইচ্ছাশক্তি আর নিষ্ঠার সমন্বয়েই আমার আজকের জায়গায় উঠে আসা। যখন যে কাজটি করেছি, মন দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। কাজের প্রতি সৎ থেকেছি। এসবই আমার সাফল্যের মূল কারণ। চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বললেন, আসলে চলচ্চিত্রেই নয়। প্রতিটি মানুষের অবস্থান নির্ভর করে নিজের ব্যক্তিত্বের উপর। সমাজের অন্যসব জায়গার মতোই চলচ্চিত্রেও নারীরা খানিকটা পিছিয়ে আছে। তবে আমি জোর গলায় বলবো, আত্মবিশ্বাস থাকলে চলচ্চিত্রেও নিজের সন্মান বজায় রেখে কাজ করা সম্ভব।
চয়নিকা চৌধুরী
মিডিয়ায় চয়নিকা চৌধুরীর পদচারণা আজকের নয়। শিশুশিল্পী হিসেবে বিটিভির নতুন কুঁড়িতে প্রথম তাকে দেখা যায়। ছোটবেলায় তাকে ‘অন দ্য স্ক্রীণ’ দেখা গেলেও এখন হয়ে উঠেছেন নেপথ্যের মানুষ। প্রথমে নাট্যকার এবং পরবর্তীতে তাকে ছোটপর্দার নাটক পরিচালনায় দেখা যায়। এইসময়ের ব্যস্ততম নির্মাতাদের মধ্যে চয়নিকা চৌধুরী অন্যতম। গত দুই ঈদে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক টিভি নাটকের নির্মাতা। এই নারী দিবসেও তার পরিচালনায় প্রচারিত হচ্ছে দুটি নাটক।
নারী নির্মাতা হিসেবে তার আজকের সাফল্যের নেপথ্যের কথা জানতে চাইলে তিনি শুরুতেই বললেন, আমি নিজেকে নারী নির্মাতা বলে মানতে নারাজ। একজন পুরুষ যেভাবে নাটক নির্মাণ করছেন, আমিও সেভাবেই নাটক নির্মাণ করছি। কাজেই আলাদাভাবে যদি ‘পুরুষ নির্মাতা’ বলা না হয়, তাহলে ‘নারী নির্মাতা’ বলাটা যুক্তি সংগত নয়। আমি একজন নির্মাতা, এটাই আমার পরিচয়। তবে হ্যাঁ প্রকৃতিগতভাবে আমি নারী। আমি নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করায় আমি গর্বিত। যদি আবার জন্মগ্রহণে সুযোগ থাকে তাহলে আমি নারী হয়েই জন্ম নেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা জানাবো। মিডিয়ার নারীর অবস্থানের কথা জানতে চাইলে চয়নিকা চৌধুরী বললেন, অন্য সব জায়গার তুলনায় এখানে নারীর অবস্থান অনেক সম্মানজনক। কেউ যদি নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে মিডিয়ায় কাজ করতে চান, তাহলে তাকে সমস্যায় পড়তে হয় না। তবে মিডিয়ায় মেয়েদের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন পারিবারিক সমর্থন। পরিবার যদি তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তাহলে কোনো মেয়ের পক্ষেই বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, একজন পুরুষ কর্মীর চেয়ে মিডিয়ায় নারীর সম্ভাবনা বেশি। কারণ পুরুষের তুলনায় যে কোনো নারী অনেক বেশি গুছিয়ে কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশ সময় ১৪১৫, মার্চ ০৮, ২০১১